গৌতম সরকার
ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি বাজে…। বৈষ্ণবনগর, ভূতনি, কালিয়াচকে ভাঙন ধরে। গঙ্গা, ফুলহর, কালিন্দীর ঢেউয়ে বাড়ি ভাঙে। আবাদ যায় তলিয়ে। ঢাকের আওয়াজে সব হারানোর হাহাকার মিশতে থাকে। শরতের সাদা মেঘ আর হঠাৎ হঠাৎ কালো মেঘ লুকোচুরি খেলে। ভারী বৃষ্টি দেখলে হৃদয় কাঁপে পারলালপুরে। দেবীর বোধন তো দূর, দ্বিতীয়ায় বিসর্জন হয়ে গেল ১৩ বাড়ি ও ২০ বিঘা জমির।
ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি বাজে! মেঘভাঙা বৃষ্টিতে কলকাতা ভাসানো জল দু’দিনে যায় নেমে। ভাঙন শুধু থামে না ভূতনি, বীরনগর, পারলালপুরে। চতুর্থ, পঞ্চমী কিংবা শরৎ বা বর্ষা- বিরাম নেই এ ভাঙনে। কলকাতায় জল নামে। মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড় ফেরে। পাল্লা দিয়ে পুজোর উদ্বোধন চলে। দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনা যাই হোক, উদ্বোধন ‘নন স্টপ।’ সঙ্গে মমতা-শুভেন্দুর টেক্কা। উদ্বোধন কার ঝুলিতে ক’টা!
ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি বাজে! কলেজ জীবনের স্মৃতি ভাসে। ছাত্র নেতাদের অলিখিত প্রতিযোগিতা রাখি উৎসবে। যে নেতার হাতে যত রাখি ওঠে, তিনি নাকি তত জনপ্রিয়। ডান-বাম, লাল-সবুজ-গেরুয়া, রাখিই নাকি কষ্টিপাথর সমর্থন যাচাইয়ের। একই সংগঠনের নেতাদের মধ্যেও চাপা রেষারেষি। তুই বড় না মুই বড়? যাঁর হাতে বেশি রাখি, সংগঠন বা ছাত্র সংসদে তাঁর পদের দাবি ও ভার বাড়ে।
বাদ্যি বাজলেই বোধন হয় কি! অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনও কোনও নেতার হাত রাখিতে ভরে গেলেও তাঁর সংগঠনের ঝুলি ভোটে ভরে না। রেষারেষির সেই বালখিল্যতা যেন ফিরেছে পুজোর উদ্বোধনে। মহালয়ার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুরু। ঘোষণা শুনেছি, তাঁর ফিতে কাটার সংখ্যা এ মরশুমে তিন হাজার। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হুংকারটা মনে পড়ে গেল- টাকা যখন সরকার দেবে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাক গলাবে না কেন!
পুজো তেমনই। লক্ষাধিক টাকার অনুদান দেবে সরকার আর উদ্বোধনের ক্ষীর খাবে অন্যে! পাগল নাকি! তবুও প্রতিযোগিতা টানটান। একটা করে উদ্বোধন করছেন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় শুভেন্দু অধিকারীর অ্যাকাউন্টে পোস্ট হয়ে যাচ্ছে ছবি। বলো দুগ্গা মাইকি! মমতার এক্স হ্যান্ডেল, ফেসবুকও চলমান ছবিতে ভর্তি। কলকাতার দুর্যোগে একদিন মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধন বন্ধ ছিল। জেলায় জেলায় উদ্বোধনে কিন্তু কোনও বনধ নেই।
কলকাতায় পাত্তা পাবেন না জেনে সেদিকে নজর দেননি বিরোধী দলনেতা। তিনি জেলা নিয়ে খুশি। কলেজের ছাত্র নেতাদের হাতের রাখি গোনার মতো বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য হিসাব করছেন, এবার উদ্বোধনের আমন্ত্রণ গত বছরের চেয়ে কটা বাড়ল? রাজ্য সরকারের অনুদান সত্ত্বেও আমন্ত্রণের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ায় ভোটের সমর্থন উপচে পড়ার আগাম আশায় আপ্লুত তিনি। যেন পুজোর উদ্বোধনের আমন্ত্রণ বাড়লে ইভিএমে পদ্ম বোতামে চাপের বন্যা নিশ্চিত।
পুজোর ঢাকের সঙ্গে ভোটের বাদ্যির বোল মিশিয়ে নতুন শরবত (ককটেল বললে অনেকে রেগে যেতে পারেন)! ‘যা দেবী সর্বভূতেষু’ আর ‘যা ভোটার সর্বভূতেষু’তে ফারাক নেই। ‘মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’র বদলে ‘ভোটাররূপেণ সংস্থিতা।’ যদিও ভোট তো এখন সমর্থন যাচাই নয়, যেনতেনপ্রকারেণ শাসন হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। যে দেব (পড়ুন ভোটার) যাতে তুষ্ট, সেটাই নৈবেদ্য।
পুজো মানে ভক্তি, পুজো মানে উৎসব, পুজো মানে বিনোদন। এই প্যাকেজের সঙ্গে ধান্দার মিশেলে ভোট-রাজনীতির বিপণনের নয়া ছক। যে ছকে দ্বিচারিতা না থেকে পারে না।
নবরাত্রিতে মমতা ডান্ডিয়া নেচেছেন বলে অমিত মালব্যর কী রাগ! এক্স হ্যান্ডেল ভরে শোকপ্রকাশের বদলে এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কড়া সমালোচনা। অথচ শুভেন্দু যে উদ্বোধনের পর উদ্বোধন করে চলেছেন, তাতে রা নেই। দুর্যোগ পরবর্তী কলকাতায় কিন্তু খোদ অমিত শা উড়ে এলেন পুজোর উদ্বোধন করতে।
অথচ কোচবিহারে গিয়েও পুজোর উদ্বোধন করলেন না বিজেপির সদ্য প্রাক্তন সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। যুক্তি, কলকাতায় এতগুলি প্রাণ চলে গিয়েছে- এই সময় পুজোর উদ্বোধন করা কি সাজে? শুভেন্দুর কিন্তু সাজল, শা’রও। দ্বিচারিতা কি গাছে ধরে! তিনি উদ্বোধন করলে তৃণমূল ঝামেলা পাকাত, পুলিশ বাধা দিত। সংঘাত এড়াতে তাই কলকাতায় মৃতদের জন্য শোকগাথা। ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যিতে কত যে রঙ্গ!
পুজোয় সরকারি অনুদান বাড়ে। পুজোর উদ্বোধনে বিজেপির আমন্ত্রণও বাড়ে। সমানুপাতিক বৃদ্ধি না ব্যস্তানুপাতিক- হিসেবটা নাহয় আপাতত তোলা থাক। কিন্তু যোগ-বিয়োগের অঙ্ক যত সহজ মনে হয়, ততটা নয়। বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সুরুচি সংঘের পুজোর উদ্বোধনী মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ যেন তারই ইঙ্গিত। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের আশীর্বাদে যদি আবার ফিরে আসতে পারি…।’ যদি শব্দটা হিসেবটায় জট পাকিয়ে দেয় নাকি!
মুশকিলটা কোথায় জানেন? মহাদেবের জটায় গঙ্গার স্রোতের মতো পদ্মপুকুরে জনসমর্থন ধারণের পরিসর, গভীরতা কিছুই নেই। যে কারণে কলকাতায় মেঘভাঙা বৃষ্টিজনিত দুর্যোগের ৭২ ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি শমীকের। দূর্গতদের পাশে দাঁড়াতে দলীয় কর্মীদের পথে নামতে পরামর্শ দিতে হয়। তার মানে ওই ৭২ ঘণ্টা হাত গুটিয়ে বসেছিলেন পদ্ম নেতা-কর্মীরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগটা হিন্দু-মুসলমানের প্রচলিত সিলেবাসের বাইরে যে! বড় অচেনা লাগে তাই!
দেখে-শুনে প্রশ্ন জাগে, পুজো উদ্বোধন কি নেতা-মন্ত্রীদের কাজ? ভোটেই বা কতটুকু লাভ তাতে? বোধনের আগে তাঁর বিসর্জন হয়ে গেলেও জুবিন গর্গ কিন্তু অচেনা পথটি দেখিয়ে গেলেন। প্রিয় গান গেয়ে জুবিনকে শেষ বিদায় জানিয়েছে যে ভিড়, তাতে ধর্ম, জাত, রাজনীতির বেড়া ভেঙে গিয়েছিল। এই জনপ্রিয়তা, এই সমর্থনের জন্য জুবিনকে কোনও পুজোর উদ্বোধন করতে হয়নি। ‘ধুমুহার হতে মোর, বহু জুগোরে নাসন’ (আমি ঝড়ের সঙ্গে বহু যুগ ধরে নেচেছি)… বার্তাটিই যথেষ্ট ছিল।