শুভদীপ শর্মা
ক্রান্তি: ২০১২ সালে আনন্দপুর চা বাগানে এক মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন একদল উন্মত্ত জনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন বছর ২০-র এক তরুণী। তিনি নিজেও তখন কলেজের ছাত্রী। জনতার কটূক্তি, এমনকি হুমকি শুনেও দমে যাননি পুনম রাই। তবে সেদিনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শুধুমাত্র শিক্ষাই চা বাগানের এই মানুষগুলোকে কুসংস্কার থেকে বের করে আনতে পারে। সেই মুহূর্ত থেকে পুনমের লড়াই শুরু হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, চা বাগানের পিছিয়ে থাকা মানুষকে আলোর দুনিয়ায় আনতে বাগানের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তুলবেন।
সেই পুনম এখন ৩২ বছরের গৃহবধূ। সংসারের চাপে অবশ্য তাঁর কাজের পরিধি এতটুকু কমেনি। বরং দিন-দিন তা আরও বেড়েছে। অসহায় দুঃস্থকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, নেশায় আসক্ত তরুণদের সুস্থ জীবনে ফেরানো বা মাইক্রো ফিন্যান্স সংস্থার ঋণের ফাঁদ এড়াতে গ্রামের বধূদের সচেতন করা— সবক্ষেত্রেই পুনম এখন আনন্দপুর তো বটেই, আশপাশের অনেক গ্রামেরই ভরসা।
রাজাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের আনন্দপুর চা বাগানের পাকা লাইনের বাসিন্দা পুনম। বাবা দিল রাই ছিলেন দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি, মা ধনমায়া গৃহবধূ। সীমিত উপার্জন এবং নিত্যদিনের অভাব সত্ত্বেও পুনম ইংরেজিতে মাস্টার ডিগ্রি করেছেন। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে টিউশনও শুরু করেন নিজের খরচ জোগাড়ের জন্য। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি তিনি তাঁর মনের কোণে সযত্নে লালন করেছেন একটা স্বপ্নকে- তা হল, চা বাগানের মানুষের জন্য কিছু করবেন। সেই স্বপ্ন দেখা থেকেই তাঁর লড়াই শুরু। দিনের পর দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুনম মেয়েদের বুঝিয়েছেন, আর্থিক দুর্বলতার সুযোগে কীভাবে আড়কাঠিরা ফাঁদ পাতে গ্রামের মেয়েদের পাচার করতে। আবার মাইক্রো ফিন্যান্সের টোপ গিয়ে ঋণের বোঝায় কীভাবে সংসার ছারখার হয়ে যায়। একসময় পুনম বুঝতে পারেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে না পারলে আগামীদিনে চা বাগানের শ্রমিকদের জীবনে অন্ধকার কাটবে না। একসময় নিজে ছোট্ট একটা স্কুল খোলেন। শিক্ষিকা হিসাবে পরিচিতি পেতেই শুরু হয় তাঁর পরবর্তী মিশন। চা বাগান আর আশপাশের গ্রামের সরকারি স্কুলে পড়া খুদে পড়ুয়াদের বিনা পয়সায় পড়ানো শুরু করেন পুনম। গ্রামের তরুণদেরও সচেতন করেছেন পুনম। বুঝিয়েছেন, নেশার কবলে পড়ে কীভাবে তাঁরা কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন, অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
ছোট্ট ছেলে জুয়েল আর স্বামী মদন অধিকারীকে নিয়ে পুনমের সংসার। পেশায় একটি রিসর্টের কর্মী মদনও স্ত্রীর এই লড়াইকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেন। তাঁর উৎসাহেই পুনম একের পর এক সচেতনতা শিবির করে গ্রামের তরুণদের বুঝিয়েছেন, ডাইনি প্রথা আসলে একটা কুসংস্কারমাত্র। পুনম বলেন, অনেক লড়াই করেছি। আজ এদিকের গ্রামগুলোতে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মারার ঘটনা আর ঘটে না। স্থানীয় গৃহবধূ লক্ষ্মী নায়েক বলেন, ‘পুনম আমাদের সচেতন করেছে, এখন আমরা তার শিক্ষা সম্প্রসারিত করছি। এখন গ্রামে কুসংস্কার অনেক কমে গিয়েছে।’
এক দশকে পুনমের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কেউ শিক্ষক হয়েছেন, কেউ চাকরিতে সফল। পুনমের অক্লান্ত পরিশ্রম অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আবার কাঁটাও এসেছে। ক্রান্তি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পঞ্চানন রায় বলেন, ‘পুনম রাইয়ের মতো একজন প্রত্যন্ত এলাকার গৃহবধূর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তাঁর মতো মানুষ থাকলে চা বাগানের বহু সমস্যা সহজেই সমাধান হত।’
বাঙালির ঘরে প্রতিবছর মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা আসেন। আর আনন্দপুর বাগানের বাসিন্দারা প্রতিদিন তাঁদের প্রতিবেশী ‘দুর্গা’-কে দেখেন, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কুসংস্কার নামের অসুরকে বিনাশ করে চলেছেন।