চেতনায় হানছে আঘাত

IMG-20250719-WA0097

ঢাকা: বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে যে বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে, তাতে ভারতের উদ্বেগ স্বাভাবিক। ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেই আঘাত যতটা লাগছে, তার থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে দুই দেশের অভিন্ন চেতনায়। ভাষা থেকে সাহিত্য, সিনেমা থেকে সংস্কৃতি, সবেতেই বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আত্মিক যোগ রয়েছে।
বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা তথা শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ময়মনসিংহের পৈতৃক ভিটে ভেঙে ফেলা হচ্ছে বলে সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে। শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। অধুনা খণ্ডহরে পরিণত হওয়া ওই বাড়ি ভাঙার খবর জানাজানি হতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এজন্য অসন্তোষ জানিয়েছে বিদেশমন্ত্রকও। উপেন্দ্রকিশোরের বাড়িটি সংস্কারে সহযোগিতা করতে চায় বলেও জানিয়েছে নয়াদিল্লি।
ভারতের কড়া অবস্থানের জেরে আপাতত বাড়ি ভাঙা স্থগিত রেখেছে ইউনূস সরকার। তবে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রক দাবি করছে, বাড়িটি উপেন্দ্রকিশোরের নয়। স্থানীয় এক জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। রায় পরিবারের বাড়িটি বহু আগে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এই দাবির সত্যতা ঘিরে অবশ্য ইউনূস সরকারের অন্দরে দ্বিমত রয়েছে।
ইউনূস জমানায় এর আগে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ধানমণ্ডির বাড়িটি কট্টরপন্থীরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের কাছারিবাড়িতেও তাণ্ডব চালিয়েছিল মৌলবাদীরা। লালন ফকিরের মাজার আক্রান্ত হয়েছিল। আরেক বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের রাজশাহির পৈতৃক ভিটেতে তাণ্ডব চলেছে। যেগুলি মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং পরিকল্পিতভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কিছু ইউনূস সরকারের রোষানলে পড়েছে। বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, নতুন বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার কোনও ঠাঁই নেই।
বঙ্গবন্ধু যে আদর্শে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দু’দেশের মৈত্রীর যে মজবুত ইমারত গড়ে তুলেছিলেন, তার ওপর ক্রমাগত বুলডোজার চালাচ্ছে ইউনূস বাহিনী। কখনও কট্টরপন্থী মৌলবাদীদের ভেক ধরে, কখনও জাতীয় নাগরিক পার্টির আড়ালে থেকে নৈরাজ্যের এই বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে অত্যন্ত দুশ্চিন্তার। কারণ, প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে তার আঁচ নিজের ঘরে আসতে বাধ্য।
ভারতের বিরুদ্ধে ইউনূস সরকারের আস্ফালনের অন্যতম প্রধান কারণ, শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লির নিরাপদ আশ্রয়দান। বাংলাদেশ বারবার দাবি করলেও হাসিনাকে ঢাকার হাতে তুলে দিতে রাজি হয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। অন্যদিকে, পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে ক্রমাগত ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা চলছে। একদিকে বরেণ্য মনীষীদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িঘর ভেঙে, তাণ্ডব চালিয়ে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আঘাত হানা হচ্ছে, অন্যদিকে ভারতের পূর্বপ্রান্তে নিরাপত্তাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে।
নয়াদিল্লি কখনও ঢাকাকে শত্রু ভাবেনি। বরং পাকিস্তান ও রাজাকার বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে এগিয়ে গিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ভারত সেই সময় বিশ্বের তাবড় শক্তির লালচোখ উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল। ইন্দিরা গান্ধি ও ভারতের সেই অবদানকে সর্বদা সম্মান করেছেন বঙ্গবন্ধু। মুজিব-কন্যাও নয়াদিল্লির সঙ্গে বরাবর সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
কিন্তু বদলের বাংলাদেশে সেই ইতিহাস পদদলিত হচ্ছে। গোপালগঞ্জ থেকে মুজিবের স্মৃতি মোছার দুঃসাহস দেখিয়ে অশান্তির আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশকে দুর্দিনের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরানো সম্ভব নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি পুনরায় জাগিয়ে তোলা না যায়, তাহলে মুক্তচিন্তার ডানা মেলা কঠিন বদলের বাংলাদেশে।

About Author

[DISPLAY_ULTIMATE_SOCIAL_ICONS]

Advertisement