পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের পাশাপাশি পাকিস্তানের একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।তার পাল্টা হিসাবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল পাকিস্তান। বৃহস্পতিবার ইসলামাদের তরফে জানানো হয়, ভারতের সঙ্গে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বন্ধ করা হল। ভারতীয় বিমানগুলিকে পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। সেই সঙ্গে ভারতীয়দের পাকিস্তানে যাওয়ার সমস্ত ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তবে শিখ পুণ্যার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দেবে পাক প্রশাসন। পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর হামলার পরেই বৈঠকে বসে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে এই বৈঠক চলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে। তারপরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিদেশসচিব বিক্রম মিসরি বলেন, সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল করছে ভারত। এছাড়াও অবিলম্বে বন্ধ করা হবে ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত। পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল করা হবে এবং বর্তমানে যেসব পাকিস্তানিরা ভারতে রয়েছেন তাঁদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে। এছাড়াও ভারত এবং পাকিস্তান-দুই দেশের হাই কমিশন থেকেই সরিয়ে নেওয়া হবে সামরিক পরামর্শদাতাদের। এই প্রেক্ষাপটেই বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে শাহবাজ শরিফের সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ রাখবে পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত হওয়া নিয়েও ভারতকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসলামাবাদ। তারা জানিয়েছে, জলপ্রবাহে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হলে সেটিকে যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে। অন্যদিকে ভারতের সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তেরও কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের দাবি, প্রতিটি জলবিন্দুতে তাদের ‘অধিকার’ রয়েছে। ভারতের সিদ্ধান্তকে ‘জল-যুদ্ধ’ হিসাবে দেখতে শুরু করেছে পাকিস্তান সরকার। সিন্ধুচুক্তি স্থগিত হওয়ার ধাক্কায় জলপ্রবাহ বাধা পেলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সেই নিয়ে উদ্বেগ দানা বেঁধেছে ইসলামাবাদে।বুধবার রাতে পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী দাবি করেছেন, “ভারত সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করা জল-যুদ্ধের শামিল… প্রতিটি জলবিন্দুর উপর আমাদের অধিকার রয়েছে এবং আমরা তা পূর্ণ শক্তিতে রক্ষা করব— আইনত, রাজনৈতিক ভাবে এবং বৈশ্বিক ভাবে।” সিন্ধু জলচুক্তিকে দুই দেশের মধ্যে অন্যতম সফল জলচুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন শাহবাজ়ের বিদেশ উপদেষ্টা সরতাজ। তাঁর বক্তব্য, “এই চুক্তি প্রত্যাহার করা হলে তা যুদ্ধের পদক্ষেপ বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।” পাল্টা হুঁশিয়ারির সুরে তিনি জানিয়েছেন, সিন্ধু জলচুক্তি লঙ্ঘন হলে তা একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত হিসাবে উঠে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্র নদীর জল আটকানোর জন্য চিনও একটি যুক্তিযুক্ত কারণ পেয়ে যাবে বলে মত পাক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার।বস্তুত, ১৯৬০ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমলে নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সিন্ধু জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল আয়ুব খান। চুক্তি অনুসারে, সিন্ধু এবং তার দুই উপনদী, বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) জলের উপরে অধিকার ও কর্তৃত্ব থাকবে পাকিস্তানের। ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে সিন্ধুর তিন উপনদী— বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু এবং ইরাবতীর জলের উপর। সামগ্রিক ভাবে সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলির মোট জলের উপর পাকিস্তানের অধিকার ৮০ শতাংশ এবং ভারতের মাত্র ২০ শতাংশ। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই জল ব্যবহার করলেও কোনও অবস্থাতেই জলপ্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না। এই অবস্থায় ভারত সিন্ধুচুক্তি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিতেই পাল্টা ব্রহ্মপুত্রের কথা বলতে শুরু করেছে পাকিস্তান। বস্তুত, ভারতের মোট মিষ্টি জলের ৩০ শতাংশ আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে, যা এই অববাহিকা অঞ্চলের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের উপস্থিতিতে বৈঠকে বসতে চলেছে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি। ভারত বুধবার রাতে পাকিস্তানের উপর প্রত্যাঘাত করার কিছু ক্ষণ পরেই এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। নয়াদিল্লির প্রত্যাঘাতের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা করতে পারে পাকিস্তানের প্রশাসন। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক প্রসঙ্গে পাক উপপ্রধানমন্ত্রী মহম্মদ ইশক দার বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপের কড়া এবং উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।’’