ভয় নয়, সচেতনতাই শক্তি স্তন ক্যান্সারের লড়াইয়ে: ডা. অনির্বাণ নাগ

IMG-20251027-WA0102

(ডা. অনির্বাণ নাগ, কনসালট্যান্ট, সার্জিক্যাল অনকোলজি, মণিপাল হাসপাতাল, রাঙ্গাপানি

রাঙ্গাপানি: অক্টোবর মাসটি হল স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস, এমন একটি সময়, যখন আমরা একে অপরের কণ্ঠকে জোরদার করি, সচেতনতা ছড়িয়ে দিই এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করার গুরুত্ব তুলে ধরি। ২০২৫ সালের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার থিম প্রতিটি গল্প আলাদা, প্রতিটি পথের মূল্য আছে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি রোগ নির্ণয়ের পেছনে লুকিয়ে আছে সাহস, দৃঢ়তা ও আশার একটি ব্যক্তিগত গল্প। যদিও স্তন ক্যান্সার বিশ্বজুড়ে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সারের একটি, তবে এটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সবচেয়ে বেশি নিরাময়যোগ্য ক্যান্সারগুলোর একটি। তাই সচেতনতা আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা। স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো চিনে নেওয়া জীবন বাঁচাতে পারে। লক্ষণ ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু কিছু সতর্ক সংকেত কখনও উপেক্ষা করা উচিত নয়। যেমন — স্তন বা বগলে নতুন গাঁট বা শক্ত অংশ অনুভব হওয়া, স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন, ত্বকে টান, ভাঁজ বা লালচে ভাব দেখা দেওয়া। কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী ব্যথা, নিপল ভিতরে ঢুকে যাওয়া, নিপল থেকে অস্বাভাবিক তরল (বিশেষ করে রক্তমিশ্রিত) নির্গত হওয়া, বা স্তনের অংশে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। যদিও এসব লক্ষণ সবসময় ক্যান্সার নির্দেশ করে না, তবে কয়েক সপ্তাহ ধরে স্থায়ী থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার, স্তন ক্যান্সার যে কাউকেই প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি যাদের কোনো সুস্পষ্ট ঝুঁকির কারণ নেই, তাদেরও। তবে কিছু কারণে ঝুঁকি বেড়ে যায়, যেমন পরিবারে স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকা, বিয়ারসিএ১ বা বিআরসিএ২ জিনের পরিবর্তন, দীর্ঘ সময় ধরে হরমোনের প্রভাব, স্থূলতা, অ্যালকোহল সেবন এবং অনিয়মিত জীবনযাপন। এসব ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা সময়মতো স্ক্রিনিং ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে।রোগ নির্ণয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয় সচেতনতা দিয়ে এবং তা ধাপে ধাপে এগোয়। সন্দেহজনক লক্ষণ দেখা দিলে প্রথমেই শারীরিক পরীক্ষা ও রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয়। এরপর করা হয় ম্যামোগ্রাফি, আল্ট্রাসাউন্ড, বা প্রয়োজনে ব্রেস্ট এমআরআই। কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে বায়োপসি করে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা হয় ক্যান্সারের উপস্থিতি। রিপোর্টে টিউমারের ধরণ, গ্রেড এবং রিসেপ্টর স্ট্যাটাস (ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন) উল্লেখ থাকে, যা চিকিৎসা পরিকল্পনা নির্ধারণে সাহায্য করে। ক্যান্সার ধরা পড়লে আরও পরীক্ষা করে দেখা হয় এটি শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়েছে কিনা। গত কয়েক দশকে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে, এবং এখন তা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিনির্ভর। চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরন, পর্যায়, বয়স, শারীরিক অবস্থা ও রোগীর পছন্দের ওপর। সাধারণত প্রথম ধাপ হিসেবে অস্ত্রোপচার করা হয়, যার মাধ্যমে টিউমার সরিয়ে যতটা সম্ভব সুস্থ টিস্যু সংরক্ষণ করা হয়। রোগের অবস্থান ও মাত্রা অনুযায়ী ব্রেস্ট কনজার্ভিং সার্জারি (ল্যাম্পেকটমি) বা মাস্টেকটমি করা হয়। প্রয়োজনে লিম্ফ নোড বায়োপসি করে দেখা হয় ক্যান্সার ছড়িয়েছে কিনা। অস্ত্রোপচারের পর সাধারণত রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়, যাতে অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হয় ও পুনরায় ফিরে আসার ঝুঁকি কমে। পাশাপাশি, সারা শরীরের ক্যান্সার কোষ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সিস্টেমিক থেরাপি ব্যবহার করা হয়, যেমন কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি (যেমন ট্রাস্টুজুম্যাব, পার্টুজুম্যাব) এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ইমিউনোথেরাপি। সাম্প্রতিক উন্নতিতে সিডিকে৪/৬ ইনহিবিটর ও পিএআরপি  ইনহিবিটর-এর মতো ওষুধ আরও কার্যকর ও ব্যক্তিগত চিকিৎসা নিশ্চিত করছে। চিকিৎসার পাশাপাশি সহায়ক ও উপশমকারী যত্নও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যা রোগীর মানসিক ও শারীরিক স্বস্তি বজায় রাখে। ক্লান্তি, বমি, হাত-পায়ে ঝিনঝিনি ভাব, মানসিক চাপ ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। মনোবিদের পরামর্শ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ও ব্যায়াম চিকিৎসার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চিকিৎসা শেষে নিয়মিত ফলো-আপ ও বার্ষিক ম্যামোগ্রাম করানো অত্যন্ত জরুরি। স্তন ক্যান্সারের যাত্রা শুধুমাত্র চিকিৎসা পর্যন্ত সীমিত নয়। সারভাইভারশিপ কেয়ার বা দীর্ঘমেয়াদি যত্নের মাধ্যমে রোগীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক প্রয়োজন পূরণ করা হয়। নারীদের উৎসাহিত করা হয় সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা এবং পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সংযোগ রাখার জন্য। পরিবার, বন্ধু ও চিকিৎসকের সমন্বিত সহায়তা একজন রোগীকে সুস্থ ও দৃঢ় করে তোলে।এই বছরের থিমটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় — স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রতিটি গল্প ভিন্ন, প্রতিটি যাত্রার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি গল্প শোনার যোগ্য, প্রতিটি পথ সহানুভূতি ও যত্নে পূর্ণ হওয়া উচিত। স্তন ক্যান্সার শুধু একটি চিকিৎসাগত সমস্যা নয়, এটি সাহস ও আশার এক গভীর ব্যক্তিগত লড়াই। সচেতনতা ছড়িয়ে, নিয়মিত স্ক্রিনিং করিয়ে ও একে অপরকে সহায়তা করে আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারি যেখানে প্রতিটি নারীর যাত্রা হবে বোঝাপড়া, শক্তি ও সুস্থ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিতে পরিপূর্ণ।

About Author

[DISPLAY_ULTIMATE_SOCIAL_ICONS]

Advertisement