প্রশান্ত কিশোর-কে ভোটকুশলী হিসেবে চেনে ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, তবে এবার তিনি নিজেই ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। প্রশান্ত কিশোর প্রথমে জেডিইউতে যোগ দিলেও নীতিশ কুমারের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে তিনি নিজেই বছর তিনেক আগে নতুন রাজনৈতিক দল জন সুরজ পার্টি গড়ে তোলেন। আর বিহার নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিয়ে পিকের বার্তা, বিহারবাসীর জন্য পিকের বার্তা, ‘বিহারের মানুষকে জাতের বেড়া ভেঙে নিজেদের জন্য নতুন দিশা তৈরি করতে হবে। যদি জাতভিত্তিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা ভেঙে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি না আসে, মানুষ একইভাবে অন্যের হাতের পুতুল হয়ে থাকবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারনা, বিহারের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোর নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করছেন। এতে বিজেপির মূল সমর্থনে সরাসরি প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। পিকে কখনও জাতপাতকে গুরুত্ব দেননি।তিনি চাইছেন নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এবং মানুষকে সচেতন করতে। বারবার তিনি বলেছেন, বিহারের মানুষকে বুঝতে হবে কীভাবে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনীতির পুরনো নিয়ম ও জাতভিত্তিক ফাঁদ ভেঙে নিজেদের জন্য নতুন পথ তৈরি করতে হবে। তিন বছরের প্রচারে তিনি যুবসমাজের মধ্যে সাড়াও ফেলেছেন। পিকে-র দাবি, তাঁর লক্ষ্য শুধু ভোট জেতা নয়, বরং মানুষকে বুঝতে সাহায্য করা এবং রাজনীতিতে নতুন দিশা দেখানো। তাই এবারের ভোট কেবল আসন ভাগের জন্য নয়, বরং রাজনীতিতে নতুন ধারা কেমন কাজ করে তা দেখারও সুযোগ। এর থেকে এটা স্পষ্ট যে, এবার পিকে শুধু ভোটকুশলী নয়, নিজেই রাজনীতির অংশ হয়ে বিহারের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাইছেন।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, প্রশান্ত কিশোরের প্রচারণায় অংশ নেওয়া জনতার প্রায় ৮০ শতাংশ তরুণ। তাঁরা রাজনীতিতে পরিবর্তন চাইছে কি না, তা আগামী নির্বাচনের ফলাফলে বোঝা যাবে। অন্যদিকে, মিডিয়ারও আকর্ষণ পিকে-র ব্যক্তিত্ব। নির্বাচন নিয়ে তাঁর মতো বিস্তারিত সাক্ষাৎকার আর কেউ দিচ্ছেন না। ভোটের পর তিনি কোনও জোটের দিকে যে ঢলবেন না তাও স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন পিকে।
পিকে-র সদিচ্ছা ও সমালোচনার ভাষা এমন যে সাধারণ মানুষও তা শুনছে। মোদি, নীতিশ কুমার, লালু-পুত্র তেজস্বী ও রাহুলের রাজনীতি নিয়ে তিনি খোলাখুলি সমালোচনা করছেন। মোদি প্রসঙ্গে বলেছেন, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলোতে মোদি শিল্পকারখানা স্থাপন করছেন, কিন্তু বিহারে তা করছেন না। ফলে, বিহারের যুবকরা অন্য রাজ্যে সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। পিকে বলেন, মোদি বিহারে শিল্পকারখানা স্থাপন করছেন না কারণ, বিহারে শিল্পকারখানা হলে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুতে সস্তা শ্রমিক পাওয়া যাবে না। পিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন— প্রধানমন্ত্রী গুজরাটে বুলেট ট্রেন চালানোর কথা বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির কথা বলেন, অথচ বিহারে বলেন আরও বেশি খাদ্য দেওয়া হবে, আরও বন্দে ভারত ট্রেন চালানো হবে। এর ফলে আরও বেশি শ্রমিক অন্য রাজ্যে চলে যাবেন বলে তাঁর দাবি। পিকে জোর দিয়ে বলেন, বিহারের যুবসমাজকে আর সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করানো চলবে না।
জেডিইউ নেতা নীতিশ কুমারের রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেন, নীতিশের রাজনীতি শেষ, এবার ২০টি আসনও জেডিইউ জিততে পারবে না। কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের নিজস্ব কিছু নেই, তারা লালু প্রসাদকে অনুসরণ করছেন মাত্র। এদিকে তেজস্বী লালু বাবার ‘জঙ্গলরাজে’ আবদ্ধ। পিকের কথায়, তেজস্বী ও রাহুল দুজনই শুধু পুরনো রাজনৈতিক প্রথার মধ্যে আটকা।
উল্লেখ্য, শাসক দল এনডিএ রাজ্যবাসীর জন্য এককালীন ১০ হাজার টাকা, শিক্ষিত বেকারদের জন্য ২ হাজার টাকা মাসিক ভাতা এবং প্রতিটি পরিবারের জন্য সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অন্যদিকে পি কের প্রতিশ্রুতি মূলত মানুষের ‘পলায়ন’ কমানো। অর্থাৎ ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমানো। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, বিহারের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.২ শতাংশ অর্থাত প্রায় ৭৪.৫৪ লাখ মানুষ অন্য রাজ্যে বসবাস করেন, যাদের মধ্যে ২২.৬৫ লাখ বা ৩০ শতাংশ মানুষ কর্মসংস্থানের কারণে অন্য রাজ্যে গিয়েছেন। তাঁদের এই অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া পি কের কাছে ‘পলায়ন’। আর এখানেই পিকের দাবি, হয় তিনি দেড়শ আসন পাবেন, নয়তো তা দশেরও কম হবে। তবে প্রত্যয়ের সঙ্গে এও জানান, ‘ফল যা-ই হোক, থেমে যাব না।’
এবারের বিহার বিধানসভা নির্বাচন শুধু রাজ্য নয় প্রভাবিত করবে জাতীয় রাজনীতিকেও।৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নীতিশ কুমারের ভবিষ্যত, বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদ এবং ইন্ডিয়া জোটের ক্ষমতা এই সবই নির্ভর করছে এই ভোটের ফলাফলের উপর। প্রশান্ত কিশোর তরুণ ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন, নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রচার করছেন এবং পুরনো রাজনৈতিক প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করছেন ঠিকই। তবে ভোটের প্রাক্কালে পিকের ক্ষমতা নিয়ে দুটি প্রশ্ন সামনে উঠে আসছে। প্রথম, তিনি এই জনসমর্থনকে ভোটে রূপান্তর করতে পারবেন কি না তা নিয়ে। সঙ্গে আরও বড় প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি হয়েছে, তিনি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত দলের প্রভাব মোকাবিলা করবেন সে ব্যাপারেও।










