‘আমাকে বাঁচাও’ উজ্জ্বল হীরক খন্ড হাজিপুর
বেবি চক্রবর্ত্তী
ডায়মন্ড হারবার, হুগলি নদীর উপকূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শহর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন হুগলি নদী লাগোয়া হাজিপুরের পূর্ব তীরের খাঁড়িতে ভাটার সময় সকালে ও বিকেলে সূর্য কিরণে প্রতিফলিত হয়ে ফুটে উঠত ধবধবে সাদা নুন৷ যাধ মাঝ নদী থেকে মনে হত উজ্জ্বল হীরক খন্ড। এই দৃশ্য দেখে পর্তুগীজ বণিকরা হাজিপুরকে ‘ডায়মন্ড ক্রীক’ নামে অভিহিত করতেন। পর্তুগিজদের রাখা এই ডায়মন্ড ক্রীক নাম থেকেই পরে হাজিপুরের অধুনা নাম হয় ‘ডায়মন্ড হারবার’।
পর্তুগিজরা দেশ ছাড়ার পর কালের নিয়মে একই রকমভাবে জলপথে বাণিজ্যের জন্য এদেশে আসে ইংরেজরা। এরপর হাজিপুরে ঘাঁটি গড়ে ব্রিটিশরা।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা ডায়মন্ড হারবারেই একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। যা ‘ডায়মন্ড হারবার চিংড়িখালি কেল্লা’ নামে পরিচিত। এই দুর্গেই নদীর দিকে নিশানা করে ইট-পাথরের বাঙ্কারে একাধিক কামান বসানো হয়েছিল। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল জলদস্যুদের হাত থেকে নিম্ন গাঙ্গেয় বাংলাকে বাঁচানো। বাণিজ্যের সুবিধার্থে সেই সময় হুগলি নদীর তীরে পোতাশ্রয় বা বন্দর গড়ে তোলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ডায়মন্ড হারবারের এই কেল্লা যে ব্রিটিশদের এক বিশেষ শক্ত ঘাঁটি ছিল, এ কথা বলাই যায়। বিচক্ষণ নাবিক ও কার্যকর বন্দর হিসেবে ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলটির কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আবার কোন কোন ইতিহাসবিদরা মনে করেন পত্তুগিজ, পর্তুগিজ কিংবা ডাচদের সময় থেকেই এখানে কেল্লা-ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নদীর নিঃশ্বাসে আজ সেইসব স্মৃতি নরম হয়ে যাচ্ছে। পুরনো কেল্লার অবশিষ্টাংশ ক্রমেই নদীগর্ভে বিলীন; কেল্লার মাঠে জলোচ্ছ্বাস, ইটকুচি ও মাটি ধস—এই দৃশ্য স্থানীয়দের কাছে এখন নিত্যদিনের উদ্বেগ। আজ কেবল কেল্লার কিছু ইটের স্তম্ভ আর মাটির স্তবিক দেখা যায়—বাকি সবই হুগলির করাল জলে লুপ্ত হতে চলেছে। কেল্লায় যাওয়ার সময় তিনটি বড় বড় রাস্তা, একটি লাইট হাউস, দু’তলা সমান ৭টি দুর্গ ও ৭টি কামান ছিল। ধীরে ধীরে নদী ভাঙনের কারণে সেই রাস্তা, দুর্গ ও লাইট হাউস সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এক সময় এই কেল্লা ছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূলে উপনিবেশিক শক্তিগুলির গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি – আজ সেই সব গৌরবগাথা ধুলোয় মিশে গিয়ে ইতিহাসের পাতা আর লোককথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই ঐতিহাসিক চিংড়িখালি কেল্লা আজ যেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক নীরব সাক্ষী।

বর্ষাকালের ভয়াবহ ভাঙন ও জোয়ারের স্রোতে বাকিটুকু কবে যে ভেসে যাবে, তা কেবল সময়ই বলবে। তবে জানা গেছে চিংড়ি খালি কেল্লা বর্তমানের রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের আওতায় তালিকাভুক্ত নয়। তবে স্থানীয় প্রশাসনের রিপোর্ট পেলে তা পর্যালোচনা করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। স্থানীয় পুরসভা ও জেলা প্রশাসনের তরফে কয়েকবার জরিপ ও অস্থায়ী মেরামতির কাজ করা হলেও স্থায়ী রক্ষার ব্যবস্থা এখনও হয়নি। প্রাচীন স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্য আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, এর তরফেও তেমন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।বিশেষজ্ঞদের মতে, কেল্লাটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর একটি বিরল নিদর্শন। এটি নদীপথ-নির্ভর বাণিজ্যব্যবস্থার ইতিহাস বহন করছে। চিংড়িখালি কেল্লা কেবল একটি পুরনো স্থাপত্য নয়, এটি বাংলার সামুদ্রিক বাণিজ্য ও উপনিবেশিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। প্রশাসনিক উদাসীনতা আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় মিলিয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এক মূল্যবান ঐতিহ্য। যদিও কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসনের তরফে সংরক্ষণের উদ্যোগের কথা উঠেছিল, তবু কার্যত কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।ইতিহাসবিদদের মতে, চিংড়িখালি কেল্লা সংরক্ষণ করা গেলে তা পর্যটন ক্ষেত্রেও এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত। ডায়মন্ড হারবার, যেখানে গঙ্গা প্রায় সাগরে মিশেছে, সেই স্থানের সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিকতা মিলিয়ে চিংড়িখালি হতে পারত এক আকর্ষণীয় ঐতিহ্যপথ। কিন্তু এখন নদীর গর্জনে সেই সম্ভাবনাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
চিংড়িখালি কেল্লা কেবল ইট-পাথরের নির্মাণ নয়, এটি দক্ষিণবঙ্গের অতীতের প্রতিচ্ছবি, আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। তাই ইতিহাসের এই সাক্ষী যদি সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় তবে তা হবে দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহ্যের এক অপূরনীয় ক্ষতি। তাই চিংড়িখালি কেল্লার ভাঙ্গা প্রাচীর আজ নিরবে বলে চলেছে, “আমাকে বাঁচাও”। স্থানীয়রা এখনও বলেন, রাতের জোয়ারের সময় কেল্লার ভেতর থেকে ভেসে আসে অদ্ভুত আওয়াজ, যেন ইতিহাসের গুঞ্জন ফিরে আসে গঙ্গার হাওয়ায়। একসময় যে দুর্গ উপনিবেশিক শক্তির প্রতীক ছিল, আজ তা দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুর দোরগোড়ায়, নীরবে বিলুপ্তির অপেক্ষায়।প্রবল জোয়ারে কেল্লার কাছাকাছি এলাকায় মাটি ধসে পড়ে। কেল্লার মূল দেওয়াল বা গড়ন বলতে এখন কেবল বিচ্ছিন্ন ইটকুচি আর ভাঙা স্তম্ভ—যা ভোরে সূর্যের আলোয় কখনও ইতিহাসের মিনতী মনে করায়, কখনও আবার ধ্বংসের চিহ্ন। কিছু অংশে গত কয়েক বছরে কাঠামোগত অবক্ষয় তীব্র হয়েছে—ভাঙন এমনভাবে গড়ে ওঠেছে যে পরিকাঠামো ও মানুষের বসতি দু’ই ঝুঁকিতে। তাই এখনই যদি সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম শুধু বইয়ের পাতায় বা পুরনো ছবিতে দেখতে পাবে সেই ইতিহাস, যে দুর্গ একদিন নদীর তীরে গর্বভরে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ তা গঙ্গার গর্ভে মিশে যেতে বসেছে। ডায়মন্ড হারবারের পুরনো কেল্লা শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়, এটি অতীতের একটি জীবন্ত সাক্ষী। এই কেল্লার ধ্বংসাবশেষ স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের অনেক অংশ হারিয়ে যায়, তবে কিছু কিছু অংশ এখনও টিকে থাকে, যা আমাদের অতীতের কথা বলে।
এক সময় এই কেল্লা ছিল ডায়মন্ড হারবারের প্রাণ – বন্দর নগরীর গৌরব, প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন। কিন্তু আজ হুগলি নদীর তীব্র ভাঙনে ইতিহাসের এই সাক্ষী কেল্লাটি ধীরে ধীরে নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। কেল্লার দেওয়াল, ইটকুচি আর মাটির ঢাল এখন কেবলই নদীর স্রোতের শিকার। ভোরবেলায় যখন সূর্যের আলো পড়ে কেল্লার ভাঙা ইটের গায়ে, তখন মনে হয় যেন ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে।











