কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

IMG-20251024-WA0059

বরুন চক্রবর্তী

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আজও বিস্ময়ের বিস্ময় , মানবতাবাদ এবং সাম্যবাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য  সমস্ত রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্পর্ধা জাগিয়ে কিশোর বয়সেই তাঁর প্রগতি চেতনার যে সকল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বিস্ময়-ই বটে।  

জাতীয়তা থেকে আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে কিশোর কবি নিরন্তর কবিতা লিখে গেছেন, সব কবিতাই তাঁর বলিষ্ঠ কবিতা হিসেবে সমুন্নত পাঠক-সমাজে পরিগণিত। যে কবিতা আবার দূরন্ত চেতনায় বশীভূত। কবিতা মাত্রই সুন্দর-এর প্রতীক, কবিতার সৌন্দর্য্য এমনিতেই বিদ্যমান। যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় চেতনার ধার-ভার শব্দের স্ফূরণ, কাজে কাজেই সেই কবিতায় চেতনার সৌন্দর্য্য ধরা দেয়,যার ফলে কথায়-ভাষায় কবিতার বিষয় আঙ্গিকে নিশ্চিত তাঁর কবিতা সৌন্দর্য্যে গড়া নির্ঘাত সৌন্দর্য্যময়, যে কবিতায় প্রতিবাদের সাথে বস্তুত আশ্বাস ও প্রত্যয় বিদ্যমান। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (*ইং ১৫ আগষ্ট ১৯২৬ – ১৩মে ১৯৪৭) মাত্র তাঁর একুশ বছর বয়সের জীবনে নির্ভীক চেতনায় প্রগতি ভাবনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। জীবনে তাঁর স্বল্প পরিসরে সুচিন্তিত চিন্তা-চেতনার গতিময়তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ রেখেছেন। মনুষ্যত্বের আলোয় নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন, সংবেদনশীল হৃদয়ের কবি মানুষের এত বিচিত্র মুখ তিনি পরখ করেছেন সেই অনুভবেও বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে এখানেও হৃদয়বান কবির কবিতায় আমরা ঐক্যসুরের পরিচয় পাইকবিও কর্তব্যপরায়ণ একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হ’য়ে কবিতায় কিছু শব্দ ভাসিয়ে দিলেন এমন তো নয়, বরং প্রতিবাদে প্রতিরোধে কবি কখনও দারুণভাবে বাদ-প্রতিবাদে সবেতেই সম্পৃক্ত। যত্রতত্র বিচ্ছিন্নতার আবহ আর সেই আবহ থেকে দুর্ভোগের প্রভাব লক্ষ্যে রেখে প্রতিবাদের মধ্যেই দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা,  কবিতায় তা প্রমাণিত সত্য হ’য়ে উঠেছে। কবিতার ভাষা কবির জাত চিনিয়ে দেয় একথা সত্যি কী না! আজকের যুগে বিবেকহীনতার শিকার  কমবেশী  সকলেই, সেই কোন্ কালে কবি তাঁর কবিতায় ভাবনার দিক্ নিদর্শন করেছেন শুধুমাত্র আপামর মানুষদের সচেতন রাখতে সবাইকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে কবি সদা জাগ্রত। শক্ত হাতে তাঁর লেখনী , নীতি আদর্শ নৈতিকতার বিশ্বাসে কবি আঁটোসাঁটো।  রিক্ত-নিঃস্ব সর্বহারা মানুষদের এত যে বঞ্চনার আঘাত, যখন যেখানে স্বার্থান্বেষীদের অপমানসুলভ আচরণ অসহ্য এই বেদনা কবি কোথায় জানাবেন?        

অনীতি-কুনীতি কার্যত কবির ধাতে সয় না। যে কারণে কবির গর্জ্জে ওঠা, অন্যায় অস্থিরতার বিরুদ্ধে কবির গর্জ্জন স্বাভাবিক,মত প্রকাশে কবি অনড় অটল। নির্ভীক চিত্তে তাঁর কলমকে চালনা করেছেন। কবিতার মাধ্যমে কবি যেভাবে তাঁর নিজস্ব মতবাদ প্রকাশ করেছেন তিনি সমদর্শী মানুষদের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন  আত্মবিশ্বাসী কবি সেই বিশ্বাস ছড়িয়ে গেলেন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যা পাথেয় ক’রে চির সত্যের কবিতা, গান,গল্প, নাটক রচনা করেছেন । তাঁর কবিতায় মানুষ-সমাজ-সভ্যতা তাও উপজীব্য আজীবন  কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষদের প্রতি তাঁর দরদী স্বভাব মনোভাব পোষণ করেছেন। আজকের সমাজের চেহারার দিকে তাকালে শঙ্কা ঠিকরে ওঠে, কোথাও অশনিসংকেত  সত্যিই তো মানুষ বড় অসহায় কোনঠাসা। এর থেকে মুক্ত হ’তে প্রশ্ন জাগে- কবির স্বপ্ন আমরা ধরে রাখতে পারবো তো! শিক্ষা, চেতনা আর মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের চাহিদা পূরণে সমর্থ হওয়ার লক্ষ্যে কবি যে দিশা দেখিয়ে গেছেন তার সফল সার্থক অবস্থা কবে ফিরবে? আমরা কবির ভাবনার সাথে সহমত পোষণ করি আশাবাদী-শোষণের যাঁতাকলে আর নয়, জনবর্গদের নিয়ে দিনগত পাপক্ষয় আর নয়, বরং সুখ-শান্তি, সুস্থ-সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যেই সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা প্রতিষ্ঠা হোক্; অধিকারের প্রশ্নে যা যা আশা করি,  শুধুই আশা নয় ,বিশ্বাস করি, সেই অধিকারের প্রশ্নে কবির স্বপ্ন-আশা একদিন পরিপূর্ণতা লাভ করবে।   

সমাজতান্ত্রিক আদর্শে প্রগতি মনস্কতায় কবি। কবির মন উন্নত চেতনায় পরিপুষ্ট, সম ভাবনায় বলীয়ান অন্য ভাবে বলতে গেলে বলতে হবে  কবির মন চেতনায় শাণিত। কবি অকপটে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, শ্রেণীদ্বন্দ্বে কবি কোন্ শিবিরে? শোষক-শোষিত ! নিশ্চয়ই শোষিতের পক্ষে শোষণের বিরুদ্ধে কবির কন্ঠ সোচ্চার। কবির শাণিত কলমে যত আগুন ত্যেজী কবিতা সময়ের প্রয়োজনের তাগিদেই রচিত, সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের দাবিতে আজও যা সমানভাবে গ্রাহ্য।  কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ‘রানার’, ‘বোধন’ , ‘কলম’ , ‘চারাগাছ’, ‘প্রিয়তমাসু’, ‘অনুভব’, ‘একটি মোরগের কাহিনী’, ‘একটি দেশলাই কাঠি’ , ‘সিপাহী বিদ্রোহ’, ‘ রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ এমন আরও কত এমন কবিতায় উৎপীড়ন আর শোষণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। আমাদের শ্রেণীবিভক্ত সমাজে  দৃষ্টিকটু গ্লানি ঝেড়ে ফেলে আসুন, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় শুধুই মশগুল নয়, প্রচারে  তৎপর হই। যে কবিতা মনে সাহস সঞ্চার করে, দুঃখ মুছে এগিয়ে চলার শক্তি জোগায়, তাঁর কবিতায় এত যে প্রাণশক্তি; অবশ্যম্ভাবী অন্যায়-শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ জাগরণের বার্তা ধ্বনিত।   

বাংলা সাহিত্যের তাঁর সমকালীন প্রেক্ষাপট টুকু বদলে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র একুশ বছরের স্বল্প জীবনে তাঁর চেতনা আর মেধার জোর দেখিয়ে গেছেন। তিনি চিরকালের জন্য মানুষের কবি কিশোর কবি হ’য়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। 

About Author

[DISPLAY_ULTIMATE_SOCIAL_ICONS]

Advertisement