বেবি চক্রবর্ত্তী
কলকাতার নর্তকী পাড়া থেকে আসল সংগীত চর্চা। এখান থেকেই গ্রামাফোন রেকর্ড শুরুই।ভারতে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড করা শিল্পী ছিলেন গওহর জান। তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য ভারতীয় গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী এবং প্রথম ভারতীয় শিল্পী। যার গান গ্রামোফোন কোম্পানি দ্বারা রেকর্ড করা হয়েছিল। তিনি একজন বাইজি ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতা ছিল বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্রস্থল। যেখানে সঙ্গীত সহ শিল্পকলার চর্চা বৃদ্ধি ঘটে। ধ্রুপদ গানের প্রচলন ও চর্চা শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে কলকাতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এর পাশাপাশি টপ্পা গানের ধারাও তখন জনপ্রিয়তা লাভ করে। কালিদাস চট্টোপাধ্যায় বা কালী মীর্জা এবং রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু-র মতো সঙ্গীতজ্ঞরা শাস্ত্রীয় রীতি মেনে টপ্পা গানকে আরও সমৃদ্ধ করেন। তাঁদের প্রভাব কলকাতার সঙ্গীত সমাজে গভীর রেখাপাত করে। এইভাবে ধ্রুপদ ও টপ্পা গানের মাধ্যমে কলকাতার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চার সূচনা হয় এবং তা ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে।তৎকালীন গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রথম ভারতীয় উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রমোহন বসু। ১৯০০ সালে এডিসনকৃত একটি ফোনোগ্রাফ রেকর্ডিং মেশিন সংগ্রহ করেন। পঠে কোম্পানির সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। হেমেন্দ্র হিজ মাস্টার’স ভয়েজ থেকে যন্ত্রপাতি ভাড়া করে স্থানীয় মনীষীদের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করতে থাকেন। পরে তিনি নিজেই কলকাতায় একটি রেকর্ডিং সংস্থা স্থাপন করেন। এই রেকডিং সংস্থা বাংলা, হিন্দি ও উর্দুতে অনেক অনুষ্ঠান ধারণ করে।
১৯০২ সালে গেইসবার্গ প্রথম একজন ভারতীয় শিল্পীর রেকর্ড তৈরি করেন এবং তিনি হচ্ছেন কলকাতার বাঙালি গওহর জান। সাত ও দশ ইঞ্চি ব্যাসের একটি রেকর্ডে তাঁর গানগুলি ধারণ করা হয়। এ রেকর্ডই তাঁকে অল্পদিনের মধ্যে খ্যাতি এনে দেয়। কলকাতার সব সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁর ছবি ছাপা হয় এবং এভাবেই ভারত অতিশীঘ্র গ্রামোফোন রেকর্ডের এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়। বিশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি জনপ্রিয় গ্রামোফোন কোম্পানি হচ্ছে হিজ মাস্টার’স ভয়েজ ব্রিটিশ, কলাম্বিয়া আমেরিকান এবং পঠে ফ্রেন্স।গ্রামোফোন তৈরি ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন এম.এল শ্ব মানিকলাল সাহা। এর আগে তিনি ছিলেন একজন হারমোনিয়াম নির্মাতা। তিনি ছিলেন লন্ডনের নিকল ফেরেস লি.-এর নিকল রেকর্ডস ও নিকলফোনের প্রথম ও প্রধান এজেন্ট। শেষ পর্যন্ত তিনি বিখ্যাত ইন্ডিয়ান রেকর্ড ম্যানিউফ্যাকচারিং কোম্পানি লি. প্রতিষ্ঠা করেন।১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার গ্রামোফোন আবিষ্কার করেন। এবং এর পেটেন্ট করে এমনটাই জানায় নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি।গ্রামোফোন ছিল টমাস এডিসনের ফোনোগ্রাফের একটি উন্নত সংস্করণ। যেখানে শব্দ রেকর্ডিং এবং প্লেব্যাকের জন্য সিলিন্ডারের পরিবর্তে ডিস্ক ব্যবহার করা হতো। এলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড। তাঁর পিতামহ ছিলেন ব্রিটিশ আর মাতামহ ছিলেন ভারতীয়। তাঁদের মেয়ে ভিক্টোরিয়া ছোট থেকেই নাচগানে পারদর্শী। ভিক্টোরিয়ার বিবাহ হয় শুষ্ক বরফ কারখানার ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ইওয়ার্ডের সাথে। ইওয়ার্ড ছিলেন আমেরিকান ইহুদি। ১৮৭৯ সালে উইলিয়াম ও ভিক্টোরিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের পর ভিক্টোরিয়া অ্যাঞ্জেলিনাকে নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে পড়েন। ১৮৮১ সালে বারাণসী চলে এলেন। খুরশিদ নামে এক মুসলিম সম্প্রদায়ের সহৃদয় ব্যক্তি ভিক্টোরিয়ার গানের প্রশংসা করলেন এবং তাঁরই বদান্যতায় প্রাথমিক সহায়তা ও মনোবল পেলেন।জন্মসূত্রে গওহর জান খ্রিষ্টান পরে তিনি ও তাঁর মা বারাণসীতে অবস্থান কালে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া ইওয়ার্ডের পরিবর্তে নাম হয় মালকা জান। ছোটবেলা থেকেই পারদর্শিতার কারণে হিন্দুস্থানী গান, কত্থক, ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পকলায় ছিল তার অনায়াস গতি। কিছুদিন বারাণসী অবস্থানের পর ১৮৮৩ সালে কলকাতায় চলে আসেন। তখন মেটিয়াবুরুজে বাস করতেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তার সভাশিল্পী হিসাবে তিন বৎসর থাকার পর নিজে কলকাতা চিৎপুর অঞ্চলে নাখোদা মসজিদের পাশে বর্তমানে ৯২, রবীন্দ্র সরণীতে একটা বাড়ি কেনেন। এখানে তাঁর সংগীত, নৃত্য ও ভাষা শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের শিক্ষা ও গুণে এমনিতেই গুণান্বিত ছিলেনই। সেই সাথে বহুবিখ্যাত ওস্তাদের যেমন পাতিয়ালা ঘরানার কালু খান, আলি বক্স জার্নেল, কিংবদন্তি কত্থকশিল্পী বৃন্দদিন মহারাজ, ধ্রুপদ শ্রীজনবাঈ, চরণ দাসের বাংলা কীর্তন কাছ থেকে তালিম নেন এবং অচিরেই নৃত্য ও সঙ্গীত পটিয়সী হয়ে ওঠেন ও খ্যাতি অর্জন করেন। মালকা ও গওহর জানের গানের খ্যাতি শুনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন পরবর্তীকালের আর এক কিংবদন্তি বেগম আখতার।১৮৭৭ সালে টমাস আলভা এডিসন ফোনোগ্রাফ আবিষ্কার করেন। যা শব্দ ধারণ ও পুনরুৎপাদনের জন্য প্রথম যন্ত্র ছিল। তবে গ্রামোফোন যা ডিস্ক ব্যবহার করে শব্দ ধারণ ও পুনরুৎপাদন করে। সেটি আবিষ্কার করেন জার্মান আমেরিকান উদ্ভাবক এমিল বার্লিনার ১৮৮৭ সালে। ১৮৯৪ সালে বার্লিনারের গ্রামোফোন এবং রেকর্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গওহর জান ছিলেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী। তিনি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঠুমরি, দাদরা, ভজন, গজল ইত্যাদি গানের জন্য পরিচিত ছিলেন।

১৯০২ সালে ভারতে গ্রামোফোন রেকর্ড চালু হয় এবং অনেক কোম্পানি রেকর্ডিং তৈরি করতে শুরু করে। গওহর জান ছিলেন প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে গান রেকর্ড করেন।কলকাতায় ধ্রুপদ গানের চর্চা শুরু হয়েছিল,বিষ্ণুপুর বাংলার এক সুপ্রাটীন সংগীতচর্চা কেন্দ্র। বাংলার ধ্রুপদ গানের শুরুয়াৎ বিষ্ণুপুরেই হয়েছিল। তখনকার সময়ে ওই অঞ্চলের রাজা বাদশাবা পশ্চিমের দরবারি সঙ্গীত শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন। রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি নিজেও সংগীতজ্ঞ ছিলেন। বিষ্ণুপুরের রামশ্কর ভট্টাচার্য মহাশয়কে এই আদি পদসংগীত গুণী রূপে মান্যতা দেওয়া হয়। রামশঙ্কর মহাশয়ের কৃতি শিষ্যমগুলীর দ্বারা বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদ বিষ্ণুপরের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলকাতা সহ সমগ্র দেশে প্রচারিত ও প্রসারিত হতে শুরু করেছিল। তীর শিষ্যমগুলীর মধ্যে ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, রামকেশব ভট্টাচার্য, কেশবলাল চক্রবতী, দীনবন্ধু গোস্বামী, রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালের স্বনামধন্য যদুভট্ট ছোটবেলায় অল্প কিছুসময় রামশঙ্কর মহাশয়ের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এই সমস্ত মহান গুণীদের হাত ধরে তৎকালীন কলকাতায় ধ্রপদ গানের প্রচলন ও চর্চা শুরু হয়েছিল। অন্যদিকে কলকাতার রাগসঙ্গীত চর্চার সেই প্রথম যুগে শাস্ত্রীয় রীতি মেনে টপ্পা গানের যে ধারা তখন কলকাতায় শুরু হয়েছিল তাকে আরও অনেক সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিলেন — কালিদাস চট্টোপাধ্যায় বা কালী মীর্জা এবং রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু। কালী মীর্জার জন্ম হুগলি জেলার শুপ্তিপাড়ায়। পরিণত বয়সে পশ্চিমাঞ্চলে উনি টপ্পা শিক্ষা করে দেশের বাড়ি ফিরে আসেন। কলকাতার তৎকালীন সঙ্গীত সমাজে ওঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তার জীবনী বিষয়ে একমাত্র প্রামাণ্য পুস্তক “গীত লহরীতে তার সম্পর্কে সবিস্তারে জানা যায়। উনি গীত রচনাও করেছিলেন। কলকাতার রাগসঙ্গীত চর্চার সেই প্রথম যুগে অন্যতম নেতৃস্থানীয় শিল্পী এবং একজন আদি অগ্রাচার্য হিসাবে ওর নাম চিরম্মরণীয় হয়ে আছে। অন্যজন রামনিধি গুপ্ত বাংলা ভাষায় শাস্ত্রীয় টপ্পা গান রচনা করেন ও শাস্ত্রীয় রীতি মেনে নতুন এক সঙ্গীত ধারার প্রবর্তন করেন। সেসময় সঙ্গীত প্রেমী মানুষদের মনোরঞ্জনে রামনিধি গুপ্ত মহাশয় যিনি নিধুবাবু নামেই সংগীত সমাজে পরিচিত হয়েছিলেন। নিধুবাবু চাকরি সূত্রে বিহারের ছাপরা শহরে কিছুকাল বাস করার সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহন করেছিলেন। বৈচিত্রময়, সুর ঐশ্বর্ষে ভরপুর, প্রগাঢ় ভাব গন্তীর এতিহ্যমণ্ডিত ধারার প্রাণবন্ত একান্তিক সাধনা সাপেক্ষ হৃদয়গ্রাহী রাগ সঙ্গীতের চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের প্রচলিত গানগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বাঙালি তথা কলকাতার শ্রোতৃমণ্ডলীর রসাস্বাদন করিয়েছিলেন।কলকাতার দর্পনারায়ণ ঠাকুর বংশীয় কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গীত সভায় মনোহর ঘরানার গুণী শিল্পী রামকুমার মিশ্রর আগমন ঘটেছিল। কলকাতা অবস্থানকালে উনি প্রচুর শিষ্য মণ্ডলী তৈরি করেছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন — মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহেশ ওস্তাদ, সতীশচন্দর চট্টোপাধ্যায়, উনি সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সভায় গায়ক ও তবলাবাদক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। লক্ষ্মী নারায়ণ বুয়াজী, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, তুলসীদাস চট্টোপাধ্যায় (ধ্রুপদী গঙ্গানারায়ণের পৌত্র) কালীপ্রসন্ন ঘোষ, নিবারণ কথক, যোগীন্দ্রনাথ ঘোষ, শত্তুচরণ মুখোপাধ্যায়, জীতেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আগ্রা ঘরানার খ্যাতি মুলত খেয়ালের জন্য। বাংলায় এই ঘরানার খেয়াল গানের প্রচার করেন ফৈয়াজ খাঁ এবং তার শিষ্য-শ্যালক আত্তা হুসেন খাঁ। গোয়ালিয়র ঘরানার বিখ্যাত ধ্রুপদীয়া শিবনারায়ণ ও গুরুপ্রসাদের কাছে সে সব বাঙালি সঙ্গীত গুণী তালিম পেয়েছিলেন তারা হলেন- শশীভূষণ দে, যদুমণি, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এঁদের মধ্যে রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী এই ঘরানার বৈশিষ্ট্য বহুদিন বজায় রেখেছিলেন। তার শিষ্যমগুলীর মধ্যে মহীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গিরিজাশক্কর চক্রবর্তী, কিশোরীমোহন ভাস্কর, ভূতনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ললিত মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দপ্রসাদ গোস্বামী এবং নাটোরের যোগীন্দরনাথ রায় উল্লেখযোগ্য। রামপুর ঘরানার খেয়াল কলকাতায় প্রচলিত হয় মূলত মেহেদি হোসেন খাঁ এবং খাদেম হুসেন খাঁ-এর মাধ্যমে। মেহেদি হোসেনের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে- গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রবোধচন্দ্র দাস, জয়কৃষ্ণ সান্যাল, সচীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, কালিদাস সান্যল। মাতৃভাষার মাধ্যমে রাগসঙ্গীত চর্চার নতুন ধারা বাংলাদেশে তথা কলকাতায় প্রচলন শুরু করেন। বাংলা ভাষায় শাস্ত্রীয় ধারার টগ্লা গান রচনার মাধ্যমে কলকাতার সঙ্গীতপ্রেমী জনগণকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা ভালবাসা বৃদ্ধি করেছিলেন। বড় বড় পশ্চিমি কলাবৎ বা ওস্তাদদের গানবাজনা শোনা ও তাঁদের কাছে তালিম নেবার উৎসাহ বৃদ্ধি করেছিলেন। সংগীত সাধনায় আজও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে রয়ে গিয়েছে।