বেবি চক্রবর্ত্তী
মন্ত্রমুগ্ধ উচ্চারণে মহালয়ার প্রভাতের আরাধনায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। বেতার সম্প্রচারণের আগে গঙ্গায় স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে মাতৃ সাধনায় মগ্ন থাকতেন কিছুক্ষণ। বন্ধ নয়নে এ যেন স্বয়ং মাতৃ আরাধনায় স্বর্গ বর্ষিত আর্শীবাদ। ১৯৩০-এর দশকে কলকাতার অল ইন্ডিয়া রেডিও মহিষাসুর মর্দিনী নামে একটি দুই ঘন্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। যেখানে দেবী দুর্গার সাথে দৈত্যরাজ মহিষাসুরের মহাকাব্যিক যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লিখেছেন বাণী কুমার এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। এটি আবৃত্তি করেছিলেন ভদ্র। এটি প্রথম ১৯৩১ সালের মহালয়াতে সম্প্রচারিত হয়েছিল। তারপর থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও ১৯৭৬ সাল ছাড়া প্রতি বছর মহালয়াতে এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করে আসছে। লাইভ-পারফরম্যান্স হিসেবে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানটি ১৯৫২ সাল থেকে পূর্ব-রেকর্ড করা বিন্যাসে সম্প্রচারিত হয়ে আসছে আজও। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সর্বাধিক পরিচিতি তাঁর অসাধারণ মহিষাসুরমর্দিনী নামক বেতার সঙ্গীতালেখ্যটির জন্য। ১৯৩১ সাল থেকে অদ্যাবধি মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় কলকাতার আকাশবাণী থেকে এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এই অনুষ্ঠানের ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেছেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ একাধিক নাটকে অভিনয় ও পরিচালনার কাজও করেন। ১৯৫৫ সালে নিষিদ্ধ ফল নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছিলেন তিনি।১৯০৫ সালের ৪ আগস্ট উত্তর কলকাতায় মাতুলালয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়। তাঁর আদি নিবাস অবিভক্ত ভারতের খুলনা জেলার উথালী গ্রামে। বর্তমানে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার ইসলামকাটি ইউনিয়নের উথালী গ্রাম। তার ডাকনাম ছিল বুশী। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র ও মা ছিলেন সরলাবালা দেবী। পরবর্তীকালে ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর কেনা ৭, রামধন মিত্র লেনে উঠে আসেন তার পরিবারবর্গ। কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি ১৪টি ভাষা জানতেন। নিম্ন আদালতে দোভাষীর কাজ করতেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। কালীকৃষ্ণ পুলিশ কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী কালীচরণ ঘোষের দ্বিতীয় সন্তান সরলাবালা দেবীকে বিবাহ করেন। ১৯২৭ সালে তিনি “রায়বাহাদুর” খেতাব পান।
কালীকৃষ্ণের দুই পুত্র জন্মায়, ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ১৯২৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯২৮ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন। এছাড়াও তিনি একাধিক ধ্রুপদি কাহিনিকে বেতার নাট্যের রূপ দেন। ১৯৩০-এর দশকে তিনি যোগ দেন আকাশবাণী কলকাতায়। এই সময় থেকেই দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে দুই ঘণ্টার সঙ্গীতালেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এই অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা করেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন। আজও দুর্গাপূজা শুরু হয় এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে। তিনি সাতটি ছদ্মনামে রেডিওতে প্রচুর অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। তিনি অনেক রম্যরচনা ও নাটক লিখেছেন।ভদ্র মেস নং ৪৯ সহ কয়েকটি নাটক লিখেছেন এবং বিখ্যাত লেখক বিমল মিত্রের বিখ্যাত উপন্যাসের মঞ্চ রূপান্তর “সাহিব বিবি গুলাম” নামে একটি থিয়েটার প্রযোজনা পরিচালনা করেছেন। ১৯৫২ সালে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস “সুবর্ণ গোলক” নাটকটি নাট্যরূপে রূপায়িত করেন যা ১৯৮১ সালে একই নামে চিত্রায়িত হয়। তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি ঐতিহাসিক নাটকের উপর ভিত্তি করে বিখ্যাত বেতার নাটক “শাহজাহান” ও প্রযোজনা করেন। ছবি বিশ্বাস সেই বেতার নাটকে শাহজাহানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এটি জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এখনও একটি ক্লাসিক বাংলা বেতার-নাটক হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি চন্দ্রগপ্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা এবং প্রফুল্ল গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা এর মতো অনেক সুপরিচিত নাটকও রেডিও নাটকের আকারে রূপান্তরিত করেন। তিনি ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার উথলি গ্রামে দুর্গা মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। মন্দিরে এখনও দুর্গাপূজা চলছে।এখনও দুর্গাপূজার সূচনায় মহালয়ার দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটির রেকর্ড আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানটি এতটাই জনপ্রিয় যে, ১৯৭৬ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিবর্তে জনপ্রিয় অভিনেতা উত্তম কুমারকে দিয়ে অন্য একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করলে, তা জনমানসে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।আকাশবাণী কর্তৃপক্ষকে সেই অনুষ্ঠানের পরিবর্তে মূল মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটিই সম্প্রচারিত করতে হয়।বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি বেতার সম্প্রচারক, নাট্যকার, অভিনেতা এবং নাট্য পরিচালক। যিনি ১৯২৮ সালে ভারতীয় ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে যোগ দেন। তিনি মূলত মহালয়া অনুষ্ঠানে “মহিষাসুরমর্দিনী” অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে তাঁর অমর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ ও দুর্গার পৃথিবীতে অবতরণের গল্প বলে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিক ও কাজী নজরুল ইসলামের সমসাময়িক ছিলেন এবং ১৯৩০-এর দশক থেকে দীর্ঘ সময় ধরে আকাশবাণী কলকাতা-তে কাজ করেছেন। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে রেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে পরবর্তীতে আকাশবাণী যোগ দেন। তাঁর অসাধারণ কণ্ঠস্বর ও অনুষ্ঠান সঞ্চালনার গুণ অল্প সময়েই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো মহালয়া উপলক্ষে সম্প্রচারিত “মহিষাসুরমর্দিনী” অনুষ্ঠান, যেখানে তিনি দেবীর মহালয়ার আবাহন করেন। এই অনুষ্ঠানে পবিত্র শ্লোক আবৃত্তি করে তিনি দুর্গার পৃথিবীতে আগমনের গল্প বলেন। বেতার সম্প্রচারক ছাড়াও তিনি নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯১ সালে ৩ নভেম্বর তিনি মারা যান। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যার কণ্ঠ শুধু বাংলাভাষীদের মধ্যেই নয় বরং ভারতীয়দের কাছেও এক অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে।মহিষাসুরমর্দ্দিনী হল একটি বহুল জনপ্রিয় প্রারম্ভিক বাংলা বিশেষ ভোরের রেডিও অনুষ্ঠান যা ১৯৩১ সাল থেকেভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অল ইন্ডিয়া রেডিও তে সম্প্রচারিত হয়ে আসছে। এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে, বর্তমানে এটি ভারত জুড়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওর অন্যান্য অনেক স্টেশন দ্বারা সম্প্রচারিত হয়। এটি শ্রী শ্রী চণ্ডী বা দুর্গা সপ্তশতীর শাস্ত্রীয় শ্লোক থেকে চণ্ডীপাঠ চণ্ডী থেকে মন্ত্র আবৃত্তির দেড় ঘন্টার অডিও মন্টেজ, বাংলা ভক্তিমূলক গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং একগুচ্ছ শাব্দিক সুর। অনুষ্ঠানটি হিন্দিতে একই রকম অর্কেস্ট্রেশনের মাধ্যমে অনুবাদ করা হয়েছে এবং একই সময়ে সমগ্র ভারতীয় শ্রোতাদের জন্য সম্প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর মহালয়ার দিন ভোরের দিকে প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি পরিবেশনা হিসেবে শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সাল থেকে। পূর্ব-রেকর্ড করা বিন্যাসে সম্প্রচারিত হচ্ছে। তবে ৯৩ বছর পরেও এর জনপ্রিয়তা আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ১ ঘন্টা ২৯ মিনিট রেডিও হোম স্টেশন আকাশবাণী।

লিখেছেন বাণী কুমার, স্ক্রিপ্ট-রাইটিংপঙ্কজ মল্লিক – সঙ্গীত রচনাবীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র – আবৃত্তিবর্ণনা করেছেন। ১৯৩১উদ্বোধনী থিম শঙ্খ বাজানোর শব্দ এবং ‘ইয়া চণ্ডী’ গান এই অনুষ্ঠানটি মহালয়ার সমার্থক হয়ে উঠেছেল। যা দেবীপক্ষের চন্দ্রপক্ষ এবং দুর্গাপূজার সূচনা উপলক্ষে পালিত হয়। আজও বাংলা এবং পূর্ব ভারতের বেশিরভাগ মানুষ এই অনুষ্ঠানের প্রতি অনুরাগী। মহালয়ার দিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে মহিষাসুরমর্দ্দিনী সম্প্রচার শুনতে পান। বর্তমানে একটি রেকর্ডিং অডিও ক্যাসেট এবং কমপ্যাক্ট ডিস্ক হিসেবে হিজ মাস্টার্স ভয়েস -RPG থেকে পাওয়া যাচ্ছে, যা অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে স্বত্ব পেয়েছে। সিডি সংস্করণে ২০০২ সালের হিসাবে ১৯টি ট্র্যাক রয়েছে। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র যিনি সর্বদা মহালয়াকে সকলের কাছে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তিনি হলেন “মহিষাসুর মর্দিনী” এর পিছনের কণ্ঠস্বর। তিনি পবিত্র শ্লোকগুলি আবৃত্তি করেন এবং দুর্গার পৃথিবীতে অবতরণের গল্প বলেন। “দেবীপক্ষ” -এর শুরুতে, মহালয়ার দিনে দেব-দেবীরা দুর্গাপূজার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য জেগে ওঠেন। ১৯৩১ সালে মহালয়া প্রথম কলকাতার আকাশবাণীতে রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, প্রেমাঙ্কুর আতোর্থি , বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র , নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এবং রাইচাঁদ বড়াল । তাঁর আবৃত্তির এই সংস্করণটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে ১৯৭৬ সালে প্রখ্যাত বাঙালি অভিনেতা উত্তম কুমারের কণ্ঠে অনুষ্ঠানটি পরিবেশিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় দুর্গা দুর্গতিহারিণী। তবে শ্রোতাদের কাছ থেকে অনুকূল সাড়া না পেয়ে এটিকে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মূল সংস্করণে ফিরিয়ে আনা হয়।১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়েই মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচারিত হয়ে আসছে। মহিষাসুরমর্দিনী এই জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠান তৈরির গল্প নিয়ে কৌশিক পালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে- মহিষাসুরমর্দিনী সম্পূর্ণ নেপথ্যকাহিনি। গ্রন্থটিতে অনুষ্ঠানে গীত গানের স্বরলিপিসহ মূল স্ক্রিপ্ট সংযোজিত হওয়ায়, বইটি ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর এখনও মহালয়া অনুষ্ঠানের মূল বিষয়। ভদ্র তাঁর সুরেলা কণ্ঠে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে মহালয়ায় আবৃত্তি করেন, তাঁর বর্ণনার ঐশ্বরিক আভায় প্রতিটি পরিবারকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলেন। অন্যদিকে বাঙালিরা প্রার্থনার শান্ত মুহূর্তগুলিতে তাঁদের আত্মাকে নিমজ্জিত করেন।