স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)
আমাদের এই সুন্দর মূল্যবান মনুষ্য জীবনে, মহালয়ার আগের অমাবস্যাটি অর্থাৎ ভাদ্র মাসের অমাবস্যাটি কৌশিকী অমাবস্যা নামে পরিচিত।শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত মহা সরস্বতী দেবীর কাহিনীতে বলা আছে, পুরাকালে একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ কঠিন সাধনা করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলে তিনি তাঁদের বর দেন, কোনও পুরুষ তাঁদের বধ করতে পারবেন না। শুধু কোনও অ-যোনি সম্ভূত নারী তাঁদের বধ করতে পারবেন। অর্থাৎ এমন এক নারী, যিনি মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেননি, তাঁর হাতেই এই দুই অসুর ভাই-এর মৃত্যু হবে। পৃথিবীতে এমন নারী পাওয়া তো কঠিন। সবাই শিবের কাছে হাজির হলেন। পার্বতী সতী রূপে দক্ষ যজ্ঞ স্থলে আত্মাহুতি দেন, তার কারণে পরবর্তী জন্মে দেবী পার্বতীর গাত্র বর্ণ কালো মেঘের মতো হয়। তাই ভোলানাথ তাকে কালিকা বলে ডাকতেন। শিব সব দেবতাদের সামনেই পার্বতীকে বললেন, “কালিকা তুমি ওদের উদ্ধার করো।” সবার সামনে কালিকা বলে ডাকায় পার্বতী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, অপমানিত বোধ করেন। রাগ করে বসলেন ধ্যানে। মানস সরোবরের ধারে কঠিন তপস্যা করেন। তপস্যান্তে শীতল মানস সরোবরের জলে স্নান করে নিজের দেহের সব কালো পরিত্যাগ করলেন ও পূর্ণিমার চাঁদের মতো গাত্র বর্ণ ধারণ করলেন। এই অমাবস্যাতে ওই কালো কোশিকাগুলি থেকে এক অপূর্ব সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ দেবীর সৃষ্টি হয়। ইনি দেবী কৌশিকী। তিনি শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন। তাই এই অমাবস্যার নাম কৌশিকী অমাবস্যা।মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবীমাহাত্ম্যম্-এ কৌশিকির কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণনা করা হয়েছে যে , শুম্ভ ও নিশুম্ভকে পরাজিত করার পর দেবতারা যখন দেবতাদের দ্বারা দেবী পার্বতীর স্তুতি গাইলেন, তখন দেবী কৌশিকি তাঁর দেহের কোষ থেকে আবির্ভূত হন। কৌশিকী নামের অর্থ হল “কোষ থেকে জাত” বা “কোষ থেকে উৎপন্ন”। পুরাণ অনুসারে, দেবী পার্বতীর কোষ থেকে কৌশিকী দেবীর জন্ম হয়েছিল, তাই এই নাম হয়। কৌশিকী অমাবস্যার দিনে দেবী পার্বতীর বিশেষ পূজা করা হয়। এই দিনে দেবী তাঁর শরীর থেকে এক নতুন শক্তির জন্ম দেন, যা “কৌশিকী” নামে পরিচিত। এই তিথিটি তন্ত্র সাধনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৌশিকী অমাবস্যা তন্ত্র ও হিন্দু শাস্ত্রে সত্য সনাতন ধর্মে একটি বিশেষ তিথি। এই দিনে দেবী পার্বতী কৌশিকী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক অসুরের বিনাশ করেন বলে এই তিথির বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। এই দিনে সাধনা করলে সিদ্ধিলাভ করা যায় এবং অশুভ শক্তি বিনাশ হয়। এই দিনে দেবী কৌশিকী অশুভ শক্তি নাশ করেন এবং শুভ শক্তির জয়লাভ হয়।এই তিথিতে তারাপীঠে বিশেষ পূজা ও আরাধনা করা হয় এবং বহু ভক্তের সমাগম হয়। কৌশিকী অমাবস্যায়, মাতারার পূজা করা হয় এবং ভক্তরা তাঁদের মনোষ্কামনা মায়ের কাছে জানান। তাই, তন্ত্রমতে এই অমাবস্যার রাতকে তারা রাত্রিও বলা হয়। এই রাতে স্বর্গ ও নরকের দ্বার কিছু সময়ের জন্য উন্মুক্ত হয় এবং সাধক তাঁর সাধনার মাধ্যমে ইচ্ছামতো শক্তি লাভ করতে পারেন। কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে কালী পূজা, তারামায়ের পূজা বা অন্যান্য দেবদেবীর পূজা করা হয়। কথিত আছে, এই তিথিতেই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন সাধক বামাখ্যাপা। তারাপীঠ মহাশ্মশানের শ্বেত শিমূল গাছের নীচে বসে সাধনা করেন বামদেব। ভক্তকে নিরাশ করেননি মাতারা। দেখা দেন বামদেবকে। সেই থেকে এই দিনে পালিত হয় কৌশিকী অমাবস্যা। যে কোনও শুভ কাজে ব্যবহৃত হয় কুশ। এই দিনে সেই কুশ কাটা হয়। তাই একে কৌশী অমাবস্যাও বলে। এই দিন কুশ কেটে রাখলে সারা বছর সেই কুশ দিয়ে পূজা অনুষ্ঠান সাধ্য পিন্ডদান করা যায়। কিন্তু, অন্য দিন তুললে যেদিন তুলবেন সেই দিনই পূজা হবে।২০২৫ সালের কৌশিকী অমাবস্যা তিথি শুরু হবে ৫ ভাদ্র, শুক্রবার ১৪৩২ সন সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে এবং শেষ হবে ৬ ভাদ্র, শনিবার ১৪৩২ সন সকাল ১১টা ২৪ মিনিটে। অর্থাৎ আগামী শনিবার ইংরাজি 23.08.2025. কৌশিকী অমাবস্যা। এই অমাবস্যা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে হয়। এই তিথিতে পূজাপাঠ ও অন্যান্য মাঙ্গলিক কাজের জন্য শুভ বলে মনে করা হয়।