বেবি চক্রবর্ত্তী

১৯৪১ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে কিন্তু তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি পোর্টব্লেয়ার বা রস আইল্যান্ডের ব্রিটিশ উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ দখল করে জাপানিরা। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত এই দ্বীপ ছিল জাপানিদের অধীনে। ঠিক সেই সময় ১৯৪৩-এর ৩০ শে ডিসেম্বর এই রস আইল্যান্ডের মাটিতে পা রেখেছিলেন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, সেখানে একদিন একরাত ছিলেনও তিনি। ১৯৪৩ সালে ৩০ ডিসেম্বর পরাধীন ভারতে পোর্ট ব্লেয়ারের (সাউথ পয়েন্টে) ভারতবর্ষের সর্ব প্রথম তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলনও করেন। বর্তমানে যেটা তেরঙ্গা পয়েন্ট নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আন্দামান বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। জাপানিরা যখন ১৯৪২ সালে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দখল নেয় এবং এক বছর পরে অস্থায়ী সরকার এবং আইএনএ, এটি সুভাষ চন্দ্র বসু ভারত স্বাধীনতা অর্জনের অনেক আগেই দ্বীপটিকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে, তিনি যেখানে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন সেটি আজ একটি মহান স্মারক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, এবং আন্দামানে একটি ঐতিহ্যবাহী সফরে দেখার সেরা স্থানগুলির মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ১৯৪৩ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তেজো আনুষ্ঠানিক ভাবে আন্দামান – নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে নেতাজির হাতে তুলে দেন।
সেলুলার জেলের অপর নাম ‘কালাপানি’। আর এই কালাপানির ওপর দিয়ে তৎকালীন কেউ বিদেশে পড়তে গেলে সমাজে তাঁকে অচ্ছুত বলে একঘরে করে রাখত। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কে এই কালাপানি পেরিয়ে আসার জন্য তখনকার সমাজ প্রথমে তাঁকে এক ঘরে করে দিয়েছিল এমনকি নিজের মায়ের সাথে দেখাও পর্যন্ত করতে দেয়নি। তবে ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত এই কারাগার। আজ থেকে বহু বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছিল। সালটা ছিল ১৯০৬! সে সময় ব্রিটিশরা দেশকে শাসন করতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু আগে থেকেই আন্দামানে ব্রিটিশদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল এই কালাপানি বা সেলুলার জেল। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেপ্তারের পর তাদের পাঠানো হতো এই কারাগারেই। তবে এই কারাগারটি কিন্তু ভয়ংকর অন্ধকূপের মতন। যা দেখলে অনেকের গাঁ শিউরে উঠবে। সে সময় আন্দামানে তেমন কেউ ভ্রমণ করতে যেত না, আর সেসময় সরকার দ্বারা সেখানে ঘুরতে যাওয়ার তখন কোনও অনুমোদনও পাওয়া যেত না। এই জেলে যারা বন্দি থাকতো যেসব কয়েদিরা নিজের জীবনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচত। প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা মুহূর্ত তাদের কাছে খুব ভয়াবহ ছিল। কিন্তু কেন কবেই বা এই জেল তৈরি হয়েছিল। কেনই বা আজও এই সেলুলার জেলের কথা শুনলে দেশবাসী এত ভয় পেয়ে যান, জানেন আপনি??
স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বিশেষ অংশ হয়ে উঠেছিল এই সেলুলার জেল। ১৮৯৩ সালে শুরু হয়েছিল এই জেল তৈরির কাজ তা শেষ হয়েছিল ১৯০৬ সালে। স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ এবং সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রায় ২০০ জন বিদ্রোহীকে আন্দামান দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। বলা হয় ১৮৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বীপগুলিকে পরিদর্শন করেছিলেন তারা। ১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকার একটি প্রতিবেদনও জমা দেন। সে সময় সরকার আন্দামান দ্বীপকে কারাগার বা জেল হিসাবে ব্যবহার করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম ১০ মার্চ ২০০ জন বিদ্রোহীকে এখানে আনা হয়েছিল।
উনিশ শতকে যখন ভারত পরাধীন ঠিক সে সময় স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল তুঙ্গে। অনেক বিদ্রোহীদের ফাঁসি তো দেওয়া হতোই, আবার অনেকের ঠাঁই হত সেই ভয়ংকর দ্বীপে। তখন ব্রিটিশ সরকার ভাবলেন এবার আন্দামানের দরকার এক নিরাপত্তা সমেত একটি কারাগার। তখনই নির্মিত হয়েছিল এই কালাপানি বা সেলুলার জেল। সে সময় বহু বিদ্রোহীকে এই কারাগারে রাখা হতো। ব্রিটিশ রাজকর্মচারী চার্লস জেমস ল্যাল এবং চিকিৎসক এ এস লেথব্রিজের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি কমিটি ১৮৯০ সালে পোর্ট ব্লেয়ার পরিদর্শন করেন এবং পোর্ট ব্লেয়ারের কাছে নির্মিত হয়েছিল এই কারাগার। বর্মা থেকে লাল রঙের ইট এনে প্রথম তৈরি হয়েছিল এই কারাগার।
এই সেলুলার জেলে বিশাল তিন তলার কাঠামো ছিল। সেখানে ভবনের সাতটি শাখা ছিল। কেন্দ্রে ছিল টাওয়ার। যেখান থেকে কারাগারের নিরাপত্তারক্ষীরা সকলের উপর নজরদারি রাখতেন। পেন্সিল ভ্যানিয়া সিস্টেম বা পৃথক সিস্টেম যেটিকে বলে, তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল এই সেলুলার জেল। জেল যাতে একজন বন্দী থেকে অপর আরেকজন বন্দি আলাদা থাকতে পারে।
সেলুলার জেলের প্রতিটি কক্ষই ১৪.৯ ফুট x ৮.৯ ফুট উচ্চতার ছিল। মানে ৩ মিটার উচ্চতা বলা চলে। প্রত্যক থাকত মাত্র একটি করে ঘুলঘুলি। যেটা মেঝে থেকে ৯.৮ ফিট উচুতে অবস্থিত। একটি বিশেষ ডিজাইন করা লোহার গিল করা দরজা থাকত। এই ছোট ঘরে কয়েদিদের বন্দি থাকার কারণে এর নাম দেওয়া হয়েছিল সেলুলার জেল। কক্ষগুলি এমন ভাবে বানানো হতো যাতে কোন বন্দি কারোর মুখ পর্যন্ত দেখতে না পান। তাঁদের যোগাযোগের উপায় পর্যন্ত ছিল না। বন্দিদের বন্দি অবস্থায় প্রতিটি মুহূর্ত ছিল বিভীষিকাময়। এটি তৈরি হয়েছিল আন্দামানের কুড়ি হাজার পাথর এবং ত্রিশ লক্ষ ইট ব্যবহার করে। এখানে লোহার গিল, চেন, শেকল চাবুকের স্ট্যান্ড, তেলকলের মতন সরঞ্জাম গুলি সব ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। যে সকল বন্দিকে সেলুলার জেলে পাঠানো হতো তাদের ওপর চলত অমানবিক ও নির্যাতন। সেই অত্যাচার অনেকেই সহ্য করতে পারতেন না। তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। গলায় লোহার রিং পায়ে লোহার শিকল বেঁধে তাদের উপর নির্যাতন করা হতো। তার ওপর তাদেরকে লাঠি দিয়ে মারা হতো। সেখানে ছিল ফাঁসির কক্ষ l কোন বাথরুমের সুবিধা ছিল না বন্দিদের। খাবার দেওয়া হতো খুব খারাপ, অস্বাস্থ্যকর। কোন কোন বন্দীকে কখনো হাতেকড়া পড়িয়ে ৬ মাসের জন্য বেঁধে রাখা হতো। নির্জন কারাগারে এভাবেই পড়ে থাকত কত বন্দি তা অনেকেরই অজানা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বহু আন্দোলনকারী যেমন বটুকেশ্বর দত্ত, উল্লাস কর, বিনায়ক দামোদর সাভারকর কে, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, হরে কৃষ্ণ কোনার, ভাই পরানন্দ সিং, সুবোধ রায়, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে এই কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য বন্দিদের মধ্যে তারাও একজন।সকল বন্দি খুব অত্যাচারিত হতো। জেলের কর্মীরা তাদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিত। যখন সেই সব বন্দি তাদের উপরেই নির্যাতিত অত্যাচার আর সহ্য করতে পারত না তারা জেল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করত, গণ অনশন ধর্মঘট করত। বিশেষ করে ১৯৩২ থেকে ১৯৩৭ সালে এই ঘটনাটি বেশি ঘটেছিল।
১৯৩৭ সালের জুলাই মাসের শুরু হয়েছিল শেষ ধর্মঘট চলেছিল। ৪৫ দিন চলেছিল। সে সময় সরকার এমন ব্যবস্থা বন্ধ অনেক ব্যবস্থা করে। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসের এই সেলুলার জেলের সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের তাদের নিজ নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠানো হয়। ১৯৩৯ সালে এই জেল খালি করতে বাধ্য করা হয়। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এসময় জাপানি সেনাবাহিনী আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে করেন। ১৯৪৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জার্মান দ্বীপপুঞ্জে কিছু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাহিন্দ সরকারকে দেওয়া হয়। যা মুক্ত ভারতের অস্থায়ী সরকার নামেও পরিচিত। পোর্ট প্লেয়ার পরিদর্শন করেন। ১৯৪৩ সালে ৩০ ডিসেম্বর আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের জিমখানা পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেলুলার জেলটি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সেই সময়ের মোরারজি দেশাই ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে জাতীয় এটি স্মৃতিসৌধ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেখানে ১৯৪৩৬ সালে সেলুলার জেলে গোবিন্দ বল্লভ পন্থ হাসপাতাল স্থাপিত করেছিলেন। যেখানে ৫০০ টি বেড ছিল এবং ৪০ জন ডাক্তার স্থানীয় জনগণকে সেবা দিত। যেটি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসনের সুরক্ষার অধীনে ছিল। সেলুলার জেলে তিনটি শাখা এতটাই ভয়ংকর যা দেখলে গা শিউরে ওঠে অনেকেই। স্বাধীনতার সংগ্রামের আন্দোলনকে দমন করার জন্য বন্দীদের ওপর কী নির্মম অত্যাচার করা হয়েছিল তা আজও অনেকের চোখে জল এনে দেবে। ১৯৪৩ সালে আন্দামান ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে ব্রিটিশ শাসক বিরোধী আন্দোলনে সফলতা পাওয়ার পর স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উড়েছিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সেটি করেছিলেন নেতাজি স্বয়ং।