অবহেলায় ভগ্ন উত্তর বারাসাতের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বাড়ি

IMG-20251203-WA0130

বেবি চক্রবর্ত্তী

ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনির্বচনীয় আলো, এক চির জাগ্রত মন্ত্র – ‘বন্দে মাতারাম’। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই সুমধুর স্তুতি। যা একসময় বাঙালি মনের গভীর থেকে উঠে স্বাধীনতা চেতনাকে বুলন্দ করেছে – বন্দেমাতরম – এই শব্দে কেবল একটি গান নয় সমগ্র ভারতের স্বাধীনতা চেতনার এক অনবদ্য প্রতীক গেঁথে আছে। ১৮৭৫ সালে ৭ই নভেম্বর বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত বন্দেমাতারাম।
এই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উত্তর বারাসাত স্টেশন থেকেই প্রায় মিনিট দশের রাস্তা সেই পুরানো বাড়ি বর্তমানে রীতিমতো অযত্নে, অবহেলায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িটি বিষাক্ত পোকামাকড়ের আস্তানায় পরিণত। শৌচকর্মের জন্যেও মানুষ আসেন এই বাড়িটিতে। অথচ এই বাড়িটিতে ১৮৭৪ সাল থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত ডেপুটি কালেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আজ সেই বাড়িটি রীতিমতো পোরো ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত। কার্যত শীতের দিনের বেলাতেই যেনও অন্ধকার নেমে এসেছে বাড়িটিতে। এলাকার মানুষ নাম গোপন রাখার শর্তে জানিয়েছেন, রাজ্য কিংবা কেন্দ্র সরকারের উচিত এই বাড়িটিকে রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে আসা অন্যথায় এই অঞ্চলটি অসামাজিক কাজের আকরায় পরিণত হবে।
তিনি সত্তরের দশকের মধ্যভাগে মননে উদিত ছন্দে এমন একটি স্তব রচনা করেন যা পরবর্তীতে সমগ্র উপমহাদেশকে স্পন্দিত করে। এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়া সত্তর – আঠাশের ডায়েরির পরে আনন্দমঠ – ১৮৮২ সালের এক ঐতিহাসিক উপন্যাস এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বন্দেমাতরমের ভাষা মূলত তৎসম ও সংস্কৃত মিশ্রিত। “সুজলাং সুফলাং”, সরল অথচ গভীর এই শব্দগুলো শুধুমাত্র প্রকৃতির বর্ণনা নয়, ছিল আত্মিক আলোকের বাণী। গানের প্রতিটি স্তব তাই কেবল কবিতাই নয়, একপ্রকার দীক্ষা।
বহু ঐতিহাসিকের মতে, গানটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল, “মাতৃভূমির প্রতি মানুষের এক গভীর নিবেদন”। এই নিবেদনই পরে স্বাধীনতার সৈনিকদের শপথের মতো কাজ করেছে।
১৮৯৬ সালের কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম গানটি পরিবেশন করেন, তখনই এই সংগীত রূপ পেল সংগ্রামের প্রতীকে। সালটা ১৯০৫ – বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর যখন সমগ্র বাংলায় প্রতিবাদের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে তখন বন্দেমাতরম হয়ে ওঠে জনতার মুখে স্লোগান। কলকাতার রাস্তায়, ছাত্রদের মিছিলে, সমাবেশে, সভামঞ্চে বন্দেমাতারাম ধ্বনি বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অরবিন্দ ঘোষ সবাই এই গানকে স্বাধীনতার যুদ্ধের ডাক বলে অভিহিত করেন। গানটি কখনো নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কখনো জনতা গোপনে গেয়ে উঠেছে কিন্তু থামানো যায়নি। এই গান হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম রাজনৈতিক ধ্বনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কন্ঠে এক অগ্নিশিখা। তাই রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন ” এই গান ভারতবাসীর অন্তরে এক ধারাবাহিক শক্তি সৃষ্টি করেছে”। বন্দেমাতারাম ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয় ধ্বনিতে ত পরিণত হয়। এই ধ্বনির তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ভীত হয়ে একবার ব্রিটিশ সরকার জনসমক্ষে এই ধ্বনি উচ্চারণ নিষিদ্ধ করে দেয়। এই সময় বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দেমাতারাম ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
বন্দেমাতরম জাতীয় আবেগে জায়গা করে নিয়েছিল। তবুও আনন্দমঠ – এর ধর্মীয় প্রতীক ও কিছু স্তবকে ঘিরে পরে বিতর্ক তৈরি হয়। বহু মানুষ মনে করেন মাতৃরূপে দেবীর উপস্থাপন কিছু সম্প্রদায়ের জন্য গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তাই গানটির শুধু প্রথম দুটো স্তব জাতীয় ব্যবহারের জন্য উপযোগী বলে ধরা হয়। কিন্তু একটি বিষয়ে স্পষ্ট বন্দেমাতরম আজ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পরিমণ্ডলের বাইরেও একটি সাংস্কৃতিক স্মৃতি, একটি ঐতিহাসিক সম্পদ।


ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় কংগ্রেসের ঐতিহ্য ভিত্তিক প্রেক্ষাপটে বন্দেমাতরমকে ‘ জাতীয় গান’ হিসাবে সম্মান জানানো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এটির মর্যাদা জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন’ -র সঙ্গে সমান সম্মানে রক্ষিত থাকে। তবে আইনি গঠনে জাতীয় গানের কথা সংবিধানে সরাসরি না থাকলেও সাংবিধানিক অনুষ্ঠানে এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৫০ বছর পর পিছনে তাকালে মনে হয় বন্দেমাতরম কেবল এক সুর বা কবিতা নয় -এটি এক যাত্রা। যে যাত্রা বাঙালি নবজাগরণের অন্তঃস্রোত থেকে শুরু হয়ে জাতীয় সংগ্রামের চূড়ায় পৌঁছেছে, আবার বিতর্কের মাঝেও তার মর্ম হারায়নি। তাই আজও যখন উচ্চারিত হয় বন্দেমাতারাম তখন যেন অদৃশ্য ভাবে আমরা সংযুক্ত হই সেই মানুষের সঙ্গে, যারা একদিন গানটির সুরে স্বাধীনতা স্বপ্ন দেখেছিল।
প্রথমে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বারুইপুর পরে বদলি হয়ে বহরমপুর এবং হুগলি জেলায় চুঁচুড়াতে পরবর্তীকালে অবসর নিয়ে ডেপুটি কালেক্টর হয়ে উত্তর বারাসত ছিলেন।


১৮৭৪ সাল থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে ছিলেন এই উত্তর বারাসাতে বাড়িতে তা যেন আজ নিছক কথিক গল্প। চারিদিকে স্থানীয়দের নোংরা আর্বজনা – প্ল্যাস্টিকের কাগজ, মূত্র ত্যাগ, মদের আসর ইত্যাদি। আজ অচিরেই ভগ্ন বাড়ি বঙ্কিমবাবুর দেওয়ালে ঘাস বড় বড় বট গাছ গজিয়ে গেছে। খসে পড়ছে দেওয়ালের ইট…! স্থানীয় থেকে শুরু করে রাজ্য – কেন্দ্র সরকার – হেরিটেজ কারুর কোনো উদ্যোগ নেই…! প্রশ্ন উঠছে ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের হেরিটেজ না হওয়া বঙ্কিমবাবুর উত্তর বারাসাতের বাড়ি শিক্ষা যেন আজ ধুলোয় পড়ে কাঁদছে…!

About Author

[DISPLAY_ULTIMATE_SOCIAL_ICONS]

Advertisement