পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ভোটার তালিকায় রয়েছে এক চূড়ান্ত অসঙ্গতি। ভোটার তালিকার প্রায় প্রতিটি পাতায় যথেষ্ট পরিমাণে ভুয়ো ভোটার, মৃত এবং স্থানান্তরিত ভোটারের নাম রেখে দেওয়াই যেন আগ্রহ নির্বাচন কমিশনের। একটি বিধানসভা কেন্দ্রকে সামগ্রিকভাবে বিচার করলে এই সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে কয়েক হাজার, যে সংখ্যা দিয়ে একটি বিধানসভার সামগ্রিক নির্বাচনী ফলাফলকে সহজেই প্রভাবিত করা যায়। গত বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনেও এইসব ভুয়ো ভোটারের ভোট পড়েছে, যা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। সিপিআই (এম) এর পক্ষ থেকে বারবার একটি স্বচ্ছ, ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের দাবি নির্বাচন কমিশনের কাছে রাখা হলেও তাতে বিশেষ কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অথচ এই অত্যাবশ্যক কাজটি না করে, মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সুষ্ট করতে, এসআইআর এর জুজু দেখানো শুরু হয়েছে। একথা স্পষ্ট যে এরাজ্যের শাসকদল চাইছে, এইসব ভুয়ো ভোটারে ভর্তি ভোটার তালিকা নিয়ে ভোটে যেতে, যাতে তাদের সন্ত্রাসী ক্যাডারবাহিনী দিয়ে এইসব ভোটকে নিজেদের অনুকূলে রাখা যায় আর বিজেপি চাইছে এই ভোটার তালিকা থেকে ভুয়ো ভোটারের পরিবর্তে বরং প্রকৃত ভোটারদের একটি অংশকে বাদ দিয়ে যাতে নিজেদের অনুকূলে ভোটের ফলাফলকে নিয়ে আসা যায়। ভোটার তালিকার যথাযথ সংশোধন নিয়ে সিপিআই(এম) এর কোনো আপত্তি নেই তো বটেই, আপত্তি রয়েছে ভোটার তালিকা নিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপির এই দূরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপকে নিয়ে।ভোটার তালিকার প্রকৃত চেহারা কতটা অসঙ্গত, তা রাজ্যের বিভিন্ন বিধানসভা ক্ষেত্রেই খতিয়ে দেখে নির্বাচন কমিশনকে নির্দিষ্টভাবে জানানো সত্ত্বেও কমিশন সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কি হওয়া উচিত তা নিয়ে আমাদের কর্মীরা যাদবপুর কেন্দ্রের কিছু অংশ নিয়ে একটি পাইলট প্রজেক্ট তৈরী করেন। তার থেকে কয়েকটি মাত্র নমুনা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এটি হিমশৈলের একটি চূড়া মাত্র, ভিতরে রয়েছে পর্বতপ্রমাণ অসামঞ্জস্য।পাইলট প্রজেক্টের ১৫০ যাদবপুর বিধানসভার ১৬৫ নম্বর বুথ। মোট ভোটার ৭০৮, ৫৬ জন মৃত ভোটারের তালিকা তৈরী করে আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা করি তাদের ডেথ সার্টিফিকেট ও মৃত্যুর নথিভুক্তিকরণ নম্বর সহ, ৫৬টি নামই তালিকা থেকে বাদ যায়। কিন্তু ১৫২ নম্বর বুথে ৮৩০ জন ভোটারের মধ্যে, একইরকমভাবে সমস্ত নথি সহ ৬৫ জন মৃত ভোটারের নাম জমা করা সত্ত্বেও ৪৮ জনের নাম এখনো তালিকায় রয়ে গেছে। আবার ১০৮ নম্বর বুথে মোট ৮০০ ভোটারের মধ্যে ৪৩ জন মৃত ভোটারের নাম সমস্ত নথি সহ জমা দিলেও একজনের নামও বাদ যায়নি।আশ্চর্যের বিষয় হল, এ বছর মার্চ মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত এই বিয়োজন এর কাজ মোটামুটি ভাবে চললেও জুলাই, ২০২৫ থেকে, নথিপত্র জমা করা সত্ত্বেও, কোন একটি অজ্ঞাত কারণে এই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বোঝা যায় যে নাম বিয়োজনের হিসেব প্রকাশ্যে আসতেই নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বাড়িতে বাড়িতে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যায়, যার পরিণতিতে নিরীহ সাধারণ নাগরিকরা অনেকেই আশঙ্কিত। যেখানে মৃত্যুর শংসাপত্র সরাসরি পাওয়া যায়নি, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জন্ম মৃত্যু নিবন্ধনীকরণ ওয়েবসাইট থেকে সংলিষ্ট কাগজ সংগ্রহ করে, সেই নথিসহ নাম বিয়োজনের জন্য আবেদন জমা করার কাজ আমাদের কর্মীরা চালু রাখেন। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ৭ আগস্ট, ২০২৫ তারিখে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সাইট, এ নাম বিয়োজন এর আবেদনপত্র (৭ নম্বর ফর্ম) জমা নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আলিপুরে সংলিষ্ট নির্বাচনী কার্যালয়ে সিইও অফিসের সিস্টেম ম্যানেজারকে বিষয়টি ওয়াকিবহাল করার পর এবং দিল্লিতে নির্বাচন কমিশন দপ্তরে বারেবারে যোগাযোগ করার পর, অবশেষে বেশ কিছু দিন পরে, উক্ত পদ্ধতি আবার চালু হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে এমন কিছু উপনিয়ম যুক্ত করা হয় যে কেবলমাত্র এই কাজকে বিলম্বিত করবে, এখানে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই আসবে যে, সিইসি নির্দেশ অনুযায়ী এসআরইআর এর কাজ তো সারা বছর জুড়ে হওয়ার কথা, তাহলে এই মৃত মানুষদের নাম বাদ দিয়ে ভোটার তালিকাকে স্বচ্ছ করার দায় রাজ্যের সংশ্লিষ্ট নির্বাচন দফতরের নেবে না কেন? এই কাজ তো রাজনৈতিক দলের কাজ নয়, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা এবং স্বচ্ছ নির্বাচন করানোটা তো নির্বাচন কমিশনের কাজ। তাহলে কি ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজে অনীহা দেখানো হচ্ছে ?যাদবপুর বিধানসভা ক্ষেত্রে মোট বুথের সংখ্যা বর্তমানে ৩৪৭, এরপর নতুন বিন্যাসে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। এই ৩৪৭ ধরে হিসেব করা যাক । প্রতি বুথে গড়ে কমবেশি ৫০ জন মৃত মানুষের নাম আছে। তাহলে ৩৪৭ বুথের ন্যূনতম এই সংখ্যাটা ১৭৩৫০। এর বাইরে স্থানান্তরিত ভোটার। এবং সাধারণভাবে অচেনা এমন ভুতুড়ে ভোটার। এই দুই মিলিয়ে বুথ পিছু সংখ্যাটা ৪০/৫০/৬০ বা কোথাও আরো বেশি। অর্থাৎ যাদবপুরে অন্তত হাজার বিশেক। শাসকদল নানা কৌশলে এবং ক্ষমতাশক্তি প্রদর্শন করে এই সমন্ত ভুয়া ভোটারের একটা বড় অংশের ভোট অবৈধভাবে ভোট বাক্সে ফেলে। ব্যাস এতেই তো ভোটের ফল ঘুরে যায়! কেন নির্বাচন কমিশন এই ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে না? কেন ভোটার তালিকা অবৈধ ভার বহন থেকে মুক্ত হবে না? শুধু ভাষণ দিলে হবে না, নির্বাচন কমিশনকে এই কাজ করে দেখাতেই হবে। বরং এই সমস্ত ভুয়া ভোটারের নাম বাদ গেলে যাদবপুরে সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ কমে যায়, যাতে নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনা এবং খরচ অনেকাংশেই কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এসব কেবল যাদবপুরেই নয়, গোটা রাজ্যজুড়েই। যেমন একইভাবে ধরা যাক ১৪৭ সোনারপুর দক্ষিণ বিধানসভার কয়েকটি বুথের স্যাম্পেল। ২৫৭ নম্বর বুথে ১০৯৪ মোট ভোটারের মধ্যে মৃত ৯৯, স্থানান্তরিত এবং ভুতুড়ে ৭২ । ২৪৬ নম্বর বুথে ১১৮২ মোট ভোটারের মধ্যে মৃত ৭৪, স্থানান্তরিত এবং ভুতুড়ে ১২। ২১১ নম্বর বুথে ১২৮০ ভোটারের মধ্যে মৃত ৬০, স্থানান্তরিত এবং ভুতুড়ে ২৮। ২৪৫ নং বুথে ভোটার ১৪৩১, মৃত ৩২, স্থানান্তরিত এবং ভুতুড়ে ৭০ জন। এসব ক্ষেত্রে একটিও নামও বাদ যায়নি। ২৫৮ নং বুথে যেখানে মোট ভোটারের সংখ্যা ৪৪৫ , সেখানে এখনো পর্যন্ত ৪১জন মৃত ভোটারের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং ৩৮৩ জন এমন ভোটার আছেন যাদের বাড়ির ঠিকানার পাশে হয় পূর্ণচ্ছেদ বা অধিক সংখ্যায় শূন্য বা ০০ দিয়ে বাড়ির নং পাওয়া গেছে। আর ভোটার তালিকায় বাড়ির ঠিকানা বহুক্ষেত্রেই এমন ভুলভাবেই রাখা হয়েছে যেন তালিকা ক্রটিপূর্ণ করার জন্যেই সাজানো আছে। সারা বছর ধরে নাকি ভোটার তালিকার সাধারণ সংশোধনের কাজ চলছে! কি করছেন নির্বাচন কমিশন ?রাজ্য সরকারের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধীকরণ তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে পদবী অনুযায়ী যাদবপুর বিধানসভা ক্ষেত্রের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মৃতের সংখ্যা (যাঁদের নাম ভোটার তালিকায় রয়ে গেছে) আদৌ কম নয়। নমুনা হিসেবে ‘দাস’ পদবিধারী মৃত মানুষের সংখ্যা ১১৯৭, ‘ঘোষ’ ৫৩৬, ‘চক্রবর্তী’ ৫০৮ এবং এইরকম অন্যান্য। নির্বাচন কমিশন এই তথ্য হাতে পায় না? ঠিক যেমন মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘শেখ’ পদবিধারী মৃত মানুষের সংখ্যা ১২১৭৯, ‘মন্ডল’ ২৬৮৬৫। এই তথ্যগুলি কি আমরা নির্বাচন কমিশনকে দেবো , না নির্বাচন কমিশন এই তথ্য যাচাই করে ভোটার তালিকা সংশোধন করে মানুষকে সঠিক তালিকা দেবে? অতএব দাবি একটাই, স্বচ্ছ মেদহীন ভোটার তালিকা তৈরি করা। ভোটার তালিকায় গোলমাল থাকলে কাদের সুবিধা এটা বুঝতে খোলা চোখে অসুবিধা হবার কথা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন কি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্যপূরণের তাগিদে কাজ করবে, নাকি মানুষের আস্থ, ভরসার প্রতীক হয়ে উঠে নিজেদের সাংবিধানিক মর্যাদার আসন রক্ষা করে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে এবং নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারবে। এটা আবারও মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে যে- নাগরিকত্ব যাচাই করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাজ, নির্বাচন কমিশনের নয়। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রকাশ এবং স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন পরিচালনা। নির্বাচন কমিশন যে সেখানে সাফল্য দেখাতে পারছে না- তা ক্রমেই দুর্ভাগ্যজনকভাবেই স্পষ্ট হচ্ছে।










