২০৩০ সালের মধ্যে ভারত কি বাল্যবিবাহ মুক্ত হবে???

child-marriage-1

শৈশবের স্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়ে কিশোরী বয়সেই বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা আজও আমাদের সমাজে এক ভয়াবহ ব্যাধি হয়ে রয়ে গিয়েছে। স্কুলে যাওয়ার পথে আলাপ, সামাজিক মাধ্যমের ভার্চুয়াল সম্পর্ক কিংবা পারিবারিক চাপে কচিকাঁচারা হুহু করে জড়িয়ে পড়ছে বাল্যবিবাহের অন্ধকারে। শৈশব বিপন্ন হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান কিশোরী মায়ের সংখ্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সমাজের ব্যর্থতা।
শুধু তাই নয়, গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে শুরু করে শহরের নামী চিকিৎসালয় পর্যন্ত এক চিত্র স্পষ্ট— অল্প বয়সে গর্ভধারণের ফলে কিশোরী মায়ের মৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার বাড়ছে, ঘটছে অস্বাস্থ্যকর ও বেআইনি গর্ভপাত। এই প্রবণতার ফাঁকে মানবপাচার কিংবা ধর্মান্তরণের মতো জঘন্য অপরাধও মাথাচাড়া দিচ্ছে। স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গোটা ভারতে বাল্যবিবাহের হার ২.১ শতাংশ হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা ৬.৩ শতাংশ। ঝাড়খাণ্ডে ৪.৬ শতাংশ। ওডিশা, বিহার, অসম, ত্রিপুরার মতো পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলিতেও সংখ্যাটা উদ্বেগজনক। উন্নত রাজ্য কেরলে যেখানে হার ১ শতাংশর কম, সেখানে উত্তরপ্রদেশ-বিহার-অসমের মতো রাজ্যে বাল্যবিবাহ রিপোর্ট হয় না বললেই চলে।
এবার আসি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কথায়। ভারতের অন্যতম অগ্রগামী সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প কন্যাশ্রী থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এখনও বাল্যবিবাহ রোধে পিছিয়ে। কন্যাশ্রী কর্মসূচি শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে মহৎ উদ্দেশ্যে— কিশোরীদের শিক্ষা অব্যাহত রাখা ও বাল্যবিবাহ রোধ। প্রায় ৯৩ লক্ষ কিশোরী এই প্রকল্পের আওতায় এসেছে, প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে প্রায় ১৬ লক্ষ নতুন কিশোরী। এ পর্যন্ত ২ লক্ষের বেশি মেয়ে এককালীন ২৫,০০০ টাকা পেয়েছে। এবছর বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ৫৯৩.৫১ কোটি টাকা।
তবুও কেন পালিয়ে বিয়ে বা কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বাড়ছে? সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও দরিদ্র পরিবারগুলো সঠিকভাবে সচেতন হয়নি। সামাজিক মাধ্যম ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা কিশোরীদের অপ্রস্তুত সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পরিবারে অস্থিরতা, মা-বাবার অক্ষমতা বা অবহেলায় মেয়েরা দিশাহীন হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের অন্বেষা ক্লিনিকগুলিতে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। প্রকল্পগুলির যথাযথ মূল্যায়ন ও নজরদারি হচ্ছে না। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো অর্থাভাবের কারণে আর আগের মতো সক্রিয় নেই। বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর প্রভাবগুলির মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি : কিশোরী মায়েরা শারীরিকভাবে প্রস্তুত নয়, ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ে। শিক্ষার ক্ষতি : বিয়ে হয়ে গেলে অধিকাংশ মেয়েকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। অপুষ্টি ও দারিদ্র্য : অল্পবয়সি মা ও শিশু দুজনেই অপুষ্টিতে ভোগে, পরিবার দারিদ্র্যের ফাঁদে বন্দি থাকে। সামাজিক অস্থিরতা : লিঙ্গবৈষম্য বাড়ে, সমাজে নারীশক্তির সম্ভাবনা নষ্ট হয়।
এই সমস্যা মেটাতে হলে কন্যাশ্রী-রূপশ্রীর মতো প্রকল্পগুলির বাস্তব প্রয়োগ ও মূল্যায়ন আরও শক্ত করতে হবে। মা-বাবা, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি জরুরি। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন কঠোরভাবে মানতে হবে। মেয়েদের নিজেদের নেতৃত্ব গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে। ডিজিটাল লিটারেসি বাড়াতে হবে।
২০১৩ সালে শুরু হওয়া কন্যাশ্রী আজ ১২ বছর পেরিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মেয়ে এর সুবিধা পেয়েছে, তবুও বাল্যবিবাহ এখনও সমাজের বড় চ্যালেঞ্জ। ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের অবসানে ভারত যে অঙ্গীকার করেছে তা পূরণ করতে হলে এখনই আরও সক্রিয় হতে হবে। শুধু সরকার নয়— পরিবার, শিক্ষক, সমাজকর্মী, জনপ্রতিনিধি, এমনকি কিশোরী-কিশোরীরা একসঙ্গে এগিয়ে এলে তবেই বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি সম্ভব।

About Author

[DISPLAY_ULTIMATE_SOCIAL_ICONS]

Advertisement