নয়াদিল্লি: ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দীপাবলির প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে। রামায়ণের সময় থেকে এই শাশ্বত রীতি বজায় রয়েছে। রামায়ণে হনুমান মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিলেন, সেই সময় তাঁকে জাম্বুবান তাঁর প্রকৃত শক্তি স্মরণ করান। হনুমানের সেই লাফ কোনও আশ্চর্য ঘটনা নয়, এটি আত্মবিশ্বাসের ফল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ভারতের অর্থনীতিকে সেই একই পথে চালিত করছেন। বিশ্বজুড়ে নানা সমস্যার মধ্যে ভারতের অর্থনীতি তার অভ্যন্তরীণ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠছে। সারা পৃথিবীতে ভিসার নতুন নিয়ম এবং করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। মোদীর নেতৃত্বে ভারত এই বিরূপ অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করছে।সাম্প্রতিক সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এইচ১বি ভিসা আবেদনকারীদের জন্য ১ লক্ষ ডলার ফি ধার্য করেছে। এছাড়াও, ব্র্যান্ডেড পণ্য এবং পেটেন্ট করা ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১০০শতাংশ করের বোঝা চাপিয়েছে। বলা হচ্ছে, সে দেশের চাকরি বাঁচাতে এই উদ্যোগ। কিন্তু, এর মধ্য দিয়ে উন্নত পৃথিবীর নিজেদের সুরক্ষিত রাখার উদ্যোগ এবং দেশের জনবিন্যাসের পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা প্রতিফলিত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই পরিস্থিতিতে দেশের তিনটি স্তম্ভকে শক্তিশালী করে তুলেছেন। এগুলি হল- দ্রুত সম্প্রসারণ, দক্ষতা এবং আত্মনির্ভর হওয়া।বিশ্বজুড়ে জনশক্তির যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, ভারতের পরিস্থিতি তার থেকে অনেক ভালো। চিনের জনসংখ্যা দ্রুত বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। সে দেশের গড়পরতা মানুষের বয়স ৪০-এর বেশি, যেখানে ভারতে তা ২৯। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩৫-এর নিচে। এ দেশের যুবশক্তি দক্ষতা, শিক্ষা এবং শিল্পোদ্যোগে বলিয়ান হয়ে উঠেছে। আর তাই, বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত চালিকাশক্তির ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে ভারতের অবদান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গত বছর বিশ্বের উন্নয়নের ১৬ শতাংশ অংশীদার ছিল ভারত। গত এক দশকের সংস্কার, বিনিয়োগ এবং পরিকাঠামো নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটি আসলে তারই প্রতিফলন। সাম্প্রতিক কিছু তথ্য এ বিষয়ে আরও আশাবাদের সঞ্চার করেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০২৬ সালে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পূর্বাভাস বৃদ্ধি করে ৬.৮শতাংশ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা বৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন বিনিয়োগ এবং দেশজুড়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে পূর্বাভাসের এই পরিবর্তন। সেপ্টেম্বর মাসে জিএসটি-র সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা। পরপর নয় মাস ধরে ১.৮ লক্ষ কোটি টাকার বেশি জিএসটি আদায় হয়েছে। উপভোক্তারা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী যথাযথভাবে কেনার ফলে বাজারে তেজি ভাব যেমন দেখা যাচ্ছে, পাশাপাশি, আগের থেকে অনেক বেশি মানুষ এখন কর দিচ্ছেন। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এই অর্থ দিয়ে ১১ মাস আমদানির কাজ করা সম্ভব হবে। জুন মাসে শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে দেখা গেছে, বিদেশ থেকে প্রবাসী ভারতীয়দের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ৩৩,২০০ কোটি ডলার, যা গত বছরের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে পিএমআই ৫৭.৭-এ পৌঁছেছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে ভারতে যে দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে, তা প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতের বাজারে তেজী ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দশেরার সময়কালে খুচরো এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে বেচা-কেনা ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে – যা সর্বোচ্চ। সিএআইটি এবং রিটেলার অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার মতো শিল্প সংস্থাগুলি জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ১৫শতাংশ বেশি বিক্রি হয়েছে। উৎসবের মরশুমের প্রথম পক্ষে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি কেনা-বেচা হয়েছে। গাড়ি, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, সোনা এবং জামাকাপড় কেনার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগের সব রেকর্ডকে দেওয়ালির মরশুম ছাড়িয়ে যাবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন এবং গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতায়নের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। দেশের অর্থনীতি এখন এক শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন গত এক দশকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের নিরিখে ভারতের স্থান চতুর্থ। মুদ্রাস্ফীতির হার আয়ত্তের মধ্যে। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে পণ্য ও পরিষেবার রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত এক নতুন রেকর্ড গড়েছে। দেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮২,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ ২২০ গিগাওয়াটের বেশি হয়েছে। এই তথ্যগুলি থেকে এটি স্পষ্ট যে, এক শক্তিশালী নেতার নেতৃত্বে ভারত একটি শক্তপোক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে, যে নেতা পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে বাস্তবায়নও করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আত্মনির্ভর ভারত গড়ার যে পরিকল্পনা করেছেন, নিছক রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেই পরিকল্পনাকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। আসলে, বিংশ শতাব্দীর ধারণায় কিছু মানুষ এখনও তাঁদের চিন্তাধারাকে আবদ্ধ রেখেছেন, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার অর্থ এই নয় যে নিজেকে আলাদা করে রাখা। আত্মনির্ভর ভারতের ধারণা হল শক্তিশালী এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বিভিন্ন সুযোগের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর ফলে, বিশ্ববাজারে ভারতীয় পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোবাইল ফোন, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং সৌরশক্তির উৎপাদনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র তৈরিতে উৎপাদন-ভিত্তিক উৎসাহ প্রকল্প শুরু হওয়ায় দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে, তার ফলে কর্মসংস্থান এবং রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।অনুসন্ধান ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন আমাদের গবেষণা ও উন্নয়নমূলক উদ্যোগকে শক্তিশালী করে তুলেছে। এই ফাউন্ডেশনের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আমাদের স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলি এবং বিভিন্ন উৎপাদন-ভিত্তিক উৎসাহ প্রকল্পের সম্প্রসারণের ফলে দেশের প্রযুক্তি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়েছে। আত্মবিশ্বাস এবং আন্তর্জাতিক স্তরে অংশীদারিত্বকে বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, আত্মনির্ভর ভারতের অন্যতম কৌশল এটিই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যোগ্য নেতৃত্বে ভারত এক অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সরকারি পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে। বর্তমানে ইউপিআই-এর মাধ্যমে যে আর্থিক লেনদেন হচ্ছে তা ভিসার চাইতেও বেশি। দৈনিক ৬৫ কোটি আর্থিক লেনদেন ইউপিআই-এর মাধ্যমে হচ্ছে। আধার, ডিজিলকার এবং ওএনডিসি এমন এক পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে যার মধ্যে দেশের নাগরিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং উদ্ভাবকরা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী-সহ বিভিন্ন দেশে ইউপিআই ব্যবস্থার সূচনা হয়েছে। এই প্রযুক্তিই এখন প্রশাসন, ক্ষমতায়ন এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। এই উন্নয়ন যজ্ঞের কেন্দ্রে রয়েছেন জনসাধারণ। বস্তুত, ৩ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি প্রবাসী ভারতীয় আজ বিশ্বে সফল এবং সম্মানিত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিকরা ১১টি ফরচুন ৫০০ সংস্থা পরিচালনা করছেন। এই সংস্থাগুলির বাজারে মূলধন ৬ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিকরা নতুন ভারতের অনুপ্রেরণার উৎস। ২০২৪ সালে এ দেশে রেমিট্যান্স বাবদ অর্থ এসেছে ১৩,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। এটি কোনও সম্পদের প্রবাহ নয়, আস্থার প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন, প্রবাসী ভারতীয়রা আমাদের মূল্যবোধ ও শিল্পোদ্যোগের দূত হিসেবে তাঁদের ভূমিকা পালন করেন।প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংঘাতময় এই বিশ্বে ভারত নতুন দিশা দেখাচ্ছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া’ এবং ‘স্কিল ইন্ডিয়া’র মতো উদ্যোগগুলি মূল্য শৃঙ্খলকে যুক্ত করেছে। এর ফলে, বিভিন্ন সম্ভাবনাকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি, শিল্পোদ্যোগে নাগরিকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। দেশের মেধা এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। একটি সর্বাঙ্গীণ গ্লোবাল স্কিলিং মিশনের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে সেখানে এই উদ্যোগগুলিকে একটি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে শংসাপত্র প্রদানের ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। বিদেশে কর্মীদের পাঠানোর আগে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যে দেশে কর্মীরা কাজ করতে যাবেন, সেই দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে সম্যক ধারণা তৈরি করা হচ্ছে। মোদীর কূটনৈতিক উদ্যোগে জি-২-জি অংশীদারিত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।হনুমানের লম্ফর যে প্রসঙ্গটির অবতারণা করা হয়েছে তা নিছকই এক প্রতীকী। এখানে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন কর্তব্য সম্পাদনার বিষয়টি বোঝানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের নীতি হল ভারতের জনগণের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অগ্রসর হওয়া। পরিকাঠামো, ডিজিটাল পরিবর্তন, পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানি এবং বিশ্বজুড়ে অংশীদারিত্বকে এই লক্ষ্য পূরণে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যেরা যখন প্রাচীর গেঁথে বাধার সৃষ্টি করছে, ভারত তখন তার দক্ষতা বৃদ্ধি করছে। বিভিন্ন দেশ যখন তার ব্যবসা-বাণিজ্যকে সঙ্কুচিত করছে, ভারত তখন তার সম্ভাবনার প্রসার ঘটাচ্ছে। অন্যান্য দেশ যখন ভবিষ্যতের আতঙ্কে রয়েছে, ভারত ভবিষ্যতের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। হনুমানের লম্ফ দেওয়া আসলে একটি রূপক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিভিন্ন প্রকল্প দেশকে তার ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করছে। কেউ যখন প্রাচীর গাঁথছেন, ভারত তখন দক্ষতার বিকাশ ঘটাচ্ছে। অন্য দেশগুলি যখন সুযোগ কমাচ্ছে, ভারত তখন সুযোগ বৃদ্ধি করছে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক আবহে ভারতীয় সভ্যতার আস্থা এখানেই নিহিত রয়েছে। আমরা আর কয়েকদিন পরেই দীপাবলি উদযাপন করব। এই আবহে বলা যায়, হনুমানের সেই লম্ফ মহাসাগরকে ছোট করেনি, বরং হনুমানের আত্মপ্রত্যয়কে বাড়িয়ে দিয়েছিল। পৃথিবী নতুন নতুন বাধার সৃষ্টি করবে। ভারতের নেতৃত্ব এবং প্রাণশক্তি সেই বাধাকে অতিক্রম করবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নে বলিয়ান হয়ে দেশ মহাসাগরের তীরে থমকে দাঁড়াবে না, সে তার শক্তিকে উপলব্ধি করে লম্বা এক লাফ দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাবে।
(লেখক- কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী)