স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)
আমাদের মূল্যবান সুন্দর মনুষ্য জীবনে বাঙালির “বারো মাসে তেরো পার্বণ” বলে প্রাচীন কাল হতে লোককথা প্রচলিত। ভাদু-পার্বণ বা ভাদু উৎসব এইরকম একটি লৌকিক উৎসবের নাম। ভাদু উৎসব প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ডের রাঁচি-হাজারিবাগ এবং অন্যান্য পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলে পালিত হয়। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে এই উৎসব শুরু হয় এবং ভাদ্র মাসের শেষ পর্যন্ত চলে। প্রচলিত লোককথা অনুসারে, মানভূম অঞ্চলের পঞ্চকোট রাজপরিবারের ভদ্রাবতী নামক এক রাজকন্যা ছিল। তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পথে যেতে যেতে ডাকাতদের হাতে তার হবু বরের মৃত্যু হয়। যা সহ্য করতে না পেরে রাজকন্যা ভদ্রাবতীও আত্মহত্যা করেন। মেয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে রাজা নীলমণি সিংহদেও এই ভাদুপুজোর সূচনা করেন। ‘ভাদু’ শব্দটি মূলত একটি লৌকিক উৎসবের নাম। ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক নারীর সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘ভাদুর’ অর্থ হিসেবে ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীরূপকে বোঝানো হয়, এবং পঞ্চকোট রাজবংশের রাজকুমারী ভদ্রাবতী বা ভদ্রেশ্বরীর নাম থেকেও এর উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। অনেকে আবার মনে করেন ‘ভাদু’ শব্দটি ভাদ্র মাস থেকে এসেছে। আবার বিয়ে করতে আসার সময় ভদ্রাবতীর হবু স্বামী ও তাঁর বরযাত্রী ডাকাতদলের হাতে খুন হলে ভদ্রাবতী চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন বলে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেট পুরুলিয়া গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীলমণি সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন।ভাদু উৎসবে ভাদুর একটি মাটির মূর্তি তৈরি করা হয় এবং এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে গান, নাচ ও অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। কোনো কোনো স্থানে ভাদু কেবল একটি পাত্রে ফুল রেখে বা অন্য কোনো প্রতীকের মাধ্যমে বিমূর্ত রূপে পূজা করা হয়। ভাদু গান মূলত গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এবং এটি বিবাহিত, প্রেম ও গ্রামীণ জীবনের অন্যান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে গাওয়া হয়। ভাদ্র মাসের প্রথম দিনে কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। ভাদ্র মাস জুড়ে মহিলারা বিভিন্ন ভাদু গান গেয়ে থাকে, যা রাঢ় বাংলার নারীদের জীবন ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি। পূজার সময় ফুল, মিষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের পিঠা যেমন: তালবড়া, এরিশা নৈবেদ্য হিসেবে উৎসর্গ করা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির পূর্ব রাতে ভাদুর জাগরণ পালিত হয় এবং রাত জেগে গান-বাজনা ও ভোগ নিবেদন করা হয়। ভাদ্র মাসের শেষ দিনে দেবীর প্রতিমা নদীর তীরে বিসর্জন দেওয়া হয়। রাজকন্যা ভাদু বা ভদ্রাবতী যার স্মৃতিকে কেন্দ্র করে, কুমারী মেয়েরা ভাদ্র মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাদু গান গেয়ে ভাদু দেবীর আরাধনা করেন। এবং ভাদ্র মাসের শেষ দিনে দেবীর প্রতিমা বিসর্জন দেন।