সপ্তর্ষি সিংহ
উত্তর কলকাতার প্রাচীন জনপদ গঙ্গা সংলগ্ন কুমারটুলি এলাকা মূলত পটুয়াপাড়া। শারদীয় উৎসবের আগে এই কুমোরটুলি এলাকায় বাড়ে মানুষের ব্যস্ততা। পুজো কমিটির অর্ডার আসতে থাকায় শুরু হয় মৃৎশিল্পীদের প্রস্তুতিও। সারা বছরই এখানকার শিল্পীরা মূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন শিল্পীরা। প্রতি বছর কুমোরটুলির স্টুডিয়ো থেকে মণ্ডপে যায় হাজার হাজার প্রতিমা। কিন্তু যেখানে প্রতিমা রূপ পায়, সেই শিল্পীদের অবস্থা শোচনীয়। অভিযোগ, যাঁরা দিনরাত এক করে মূর্তি গড়ার কাজ করেন, সেই কুমোরটুলির শিল্পীদের খোঁজ রাখে না কেউ। এখানে অনেক শিল্পী আসেন বাইরে থেকে। প্রতিমা তৈরির জন্য জোগাড়ের কাজেও আসেন অনেকে। শিল্পীরা মূলত কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান থেকে এখানে কাজে আসেন তাঁরা। রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। তবে তৃণমূল এখনও পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকারের উন্নয়নের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়নি বলে অভিযোগ করে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মৃৎশিল্পীরা। অভিযোগ, আগের সরকারের নেওয়া কুমোরটুলি উন্নয়নের কফিনে পড়ে গেল শেষ পেরেক। তারপর ১৫ বছর কেটেছে, কিন্ত রাজ্যের ‘উন্নয়নের জোয়ারের’ আঁচ এই পটুয়া পাড়ায় পড়েনি। এক শিল্পী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিমা তৈরির আগে, পরে আমরা দিন রাত এক করি, কিন্তু আমাদের ন্যূনতম সুযোগসুবিধা নেই। এই সমস্যাগুলির দ্রুত সমাধান করা জরুরি। আমি প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন করব’।প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো আঁধারই থেকে যায় কুমোরটুলির শিল্পীমহলে। উৎসব এলে আলোর রোশনাইয়ে ভরে ওঠে চারিদিক। কিন্তু সেই আলো পৌঁছয় না শিল্পীদের ঘরে। শিল্পীমহলে এখন একটাই কথা, ‘যন্ত্রণাই আমাদের ভবিষ্যৎ’।কুমোরটুলির ভিতরে শুধুই অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি। প্লাস্টিক স্তূপ যেন জতুগৃহে পরিণত হয়েছে। শিল্পীদের কথায়, এই ছবিটা বদলে যেত, যদি বাস্তবায়িত হত বাম আমলে তৈরি করা উন্নয়ন পরিকল্পনা। কিছু শিল্পীরা বলেছেন, প্রতিমা তৈরিতে মূলত দুই ধরনের মাটি লাগে। এঁটেল মাটি ও বেলে মাটি। বেলে মাটি সাধারণত নরম হয়। পলিমাটি আসলে বেলে মাটি। কুমারটুলি সংলগ্ন ঘাট গুলিতে এ মাটি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিমা তৈরিতে প্রধানত লাগে এঁটেল মাটি। খড়ের গায়ে এঁটেল মাটি লাগানো হয়। এই মাটি আগে উলুবেড়িয়া থেকে আসতো। গঙ্গার তলার মাটি কেটে নৌকা করে এসে বিক্রি করত এই কুমারটুলিতে। কিন্তু এখন হচ্ছে না। এখন মাটি আনতে হয়। ডায়মন্ডহারবার পাথরপ্রতিমা কাকদ্বীপ এই চত্বর থেকে। জমি কাটা মাটি, বর্তমানে ব্যবহার করা হয় প্রতিমা তৈরির জন্য। বেশি টাকা দিয়ে অতিরিক্ত গাড়ি ভাড়া খরচ করে এই মাটি আনতে হয় কুমারটুলিতে। কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সমিতির সূত্রে জানা গিয়েছে, কুমোরটুলির আমূল সংস্কার করার পরিকল্পনা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে পুনর্বাসন দিয়ে উন্নয়নের কাজ করার কথা ছিল। শিল্পীদের কংক্রিট স্টুডিয়ো হত। উপরে কারিগরদের থাকার জায়গা, রান্নাঘর, শৌচালয় তৈরিও ছিল পুনর্বাসন পরিকল্পনার অংশ। গড়ে উঠত শিশু উদ্যান। থাকত ২৪ ঘণ্টা জল পরিষেবা, আলোকায়ন ৷ রাস্তা হত পিচ ও কংক্রিটের। সাফাইয়ের বিশেষ ব্যবস্থাও থাকত । আরও অনেক কিছু ছিল ওই পুনর্বাসন পরিকল্পনায়। এক মৃৎশিল্পী বলেছেন, ‘‘শেষ দু’বছরে দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। যে হারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে সেই অনুযায়ী দাম বাড়েনি প্রতিমার। আগে ছোট ঠাকুর হতো। বর্তমানে প্রতিমার সাইজ বেড়েছে। তার জন্য বেশি মাটি লাগে, খড় লাগে। শ্রমিকদের মজুরি দিতে হচ্ছে। পেশায় নিশ্চয়তা কমে যাওয়ায় শিল্পীদের ক্ষোভ, সাত-আট বছর আগে প্রতিমা তৈরির ঘরগুলি নতুন করে করে দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু কোনও অদৃশ্য কারণে তা আর হয়নি।