ডা. দেবব্রত সেন, (আয়ুর্বেদাচার্য ও প্রতিষ্ঠাতা – পরম্পরা আয়ুর্বেদ)
শহুরে জীবনের গতি যতটা দ্রুত, তার চাপও ততটাই তীব্র। অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, সারাদিনের যাতায়াত, অতিরিক্ত স্ক্রিনে সময় কাটানো আর ক্রমাগত মানসিক চাপ—এইসব মিলিয়ে বহু নারী প্রতিদিন ক্লান্তি, ঘুমের অভাব ও জীবনধারাজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন। জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রজননক্ষম ভারতীয় নারীদের অর্ধেকেরও বেশি রক্তাল্পতায় আক্রান্ত। প্রতি ১০ জন শহুরে নারীর একজন পিসিওএস -এ ভুগছেন। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের অর্ধেক যথেষ্ট সক্রিয় নন। এই প্রেক্ষাপটে আয়ুর্বেদ আমাদের টেকসই সমাধান দেয়—দিনচর্যা বা দৈনন্দিন রুটিনে নিয়ম আনা, হজমশক্তি (অগ্নি)কে স্থিতিশীল রাখা এবং মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনা। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এখন ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসার গুরুত্ব স্বীকার করেছে।চারটি সহজ আয়ুর্বেদিক অভ্যাস:
১. দিনের শুরুটা সঠিকভাবে করুন। সকালে উঠে জলপান, অস্থিরতা ছাড়া প্রাতঃকৃত্য, আর ঘুম থেকে ওঠার ৯০ মিনিটের মধ্যে উষ্ণ প্রাতঃরাশ। রোদে সামান্য হাঁটাহাঁটি করলে মেজাজ ও ঘুম দুটোই ভালো হয়।
২. দুপুরে সবচেয়ে বড় খাবার। আয়ুর্বেদ বলে মধ্যাহ্নে হজমশক্তি সবচেয়ে প্রবল। তাই দুপুরের খাবার হোক সুষম ও আয়রনসমৃদ্ধ। শস্য, ডাল, সবজি, আচার ও ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার একসঙ্গে খেলে রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য হয়।
৩. রাতে শরীরকে ধীরে নামান। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার, নরম আলো এবং ১০ মিনিট নাড়িশোধন প্রণায়াম স্নায়ুকে শান্ত করে। এতে হজম, ঘুম ও ঋতুচক্র নিয়মিত হয়।
৪. প্রায় প্রতিদিন নড়াচড়া করুন। হাঁটা, সাইক্লিং, যোগাসন ও শক্তিবর্ধক ব্যায়ামের মিশ্রণ শরীরকে সক্রিয় রাখে। এতে নারীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান নিষ্ক্রিয়তার সমস্যা কমে।পিসিওএস ও নারীর স্বাস্থ্য-অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও অস্থির ঘুম শহুরে নারীদের মধ্যে পিসিওএসের প্রবণতা বাড়াচ্ছে। ওজন নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও ভালো ঘুম—এই চারটি স্তম্ভই প্রাথমিক প্রতিরোধ, যা আয়ুর্বেদের সঙ্গে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানসিক চাপ ও ঘুম-শহরের অদৃশ্য দূষণ হলো অতিরিক্ত মানসিক চাপ। এটি পিএমএস, পিসিওএস ও হজম সমস্যাকে আরও খারাপ করে। নিয়মিত প্রণায়াম, স্ব-ম্যাসাজ (অভ্যঙ্গ), ডিজিটাল সানসেট এবং তাড়াতাড়ি রাতের খাবার—এই সহজ পদক্ষেপগুলো মানসিক ভারসাম্য আনে এবং ভালো ঘুমে সাহায্য করে। এক সপ্তাহের সহজ রিসেট-সকালে জলপান ও সূর্যালোকে হাঁটা, প্রোটিনসমৃদ্ধ প্রাতঃরাশ; দুপুরে আয়রনসমৃদ্ধ প্রধান আহার; বিকেলে কিছু শরীরচর্চা; রাতে হালকা আহার; ঘুমের আগে নিদ্রা চা; আর রাত ১১ টার মধ্যে ঘুম। সপ্তাহে দুদিন শক্তিবর্ধক ব্যায়াম ও ত্রিফলা নিয়মিত গ্রহণে আলস্যও দূর হয়।শেষকথা-ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা কোনো অতীতচর্চা নয়, বরং জীবনের সঠিক ছন্দে ফেরার পথ। শহুরে নারীরা—যাঁরা রক্তাল্পতা, পিসিওএস, মানসিক চাপ ও অস্থির জীবনে ভুগছেন—তাঁদের জন্য আয়ুর্বেদ এক বাস্তবসম্মত সমাধান। শুরু করুন দুটি সহজ পরিবর্তনে: দুপুরে সবচেয়ে বড় খাবার খাওয়া এবং রাত ১১ টার আগে মোবাইল ফোন শোবার ঘরের বাইরে রাখা। ফল মিলবে শক্তি, হরমোনের ভারসাম্য ও মানসিক প্রশান্তিতে।ডা. দেবব্রত সেন দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আয়ুর্বেদাচার্য, শিক্ষক ও বিশ্বজোড়া ভারতীয় চিকিৎসা ঐতিহ্যের প্রবক্তা। তাঁর লক্ষ্য—আয়ুর্বেদকে আধুনিক জীবনে সহজ ও কার্যকর করে তোলা।