মানবসেবায় নিবেদিত প্রাণ নিবেদিতা

IMG-20250827-WA0127

বেবি চক্রবর্ত্তী 

ভারতবর্ষ একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতে বর্তমান অতীতের সাথে জড়িত জাতীয়তাবাদ। দুঃখ দারিদ্রে ভরা পরাধীন ভারতের গ্লানি দূর করার জন্য দরকার ছিল শিক্ষা, শিক্ষাই হলো মানুষের মেরুদণ্ড। তাই মানব সমাজকে শিক্ষিত করার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ”আগে মা শিক্ষিত হলে পরে তার সন্তান শিক্ষিত হবে”। তাই স্বামীজি মনে করেন সমাজকে শিক্ষিত করে তুলতে হলে দরকার নারী শিক্ষা। ১৮৬৭ সালের ২৮শে অক্টোবর তাইয়নের ভ্যানগণে স্বদেশপ্রেমী ধর্মযাজক স্যামুয়েল রিচম্যান আর মাতা মেরী ইজাবেলের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এক সিংহিনী মহীয়সী নারী– তিনি আর কেউ নন তিনিই হলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। মার্গারেটের পরিবার স্কটল্যান্ড এর অধিবাসী ছিলেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হলে মেরি ইজাবেল স্কটল্যান্ড ছেড়ে আয়ারল্যান্ডে পিতার বাড়ি চলে আসেন। এরপর ১৮৮৪ সালে বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মার্গারেট।তিনি মাত্র ১৭বছর বয়সে শিক্ষিকা ও লেখিকা হয়েছিলেন। পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সংসার তাঁর জন্য নয়। অবশেষে তিনি নিজেকে ধর্মীয় কাজের মধ্যে মনোনিবেশ করান। চার্চের অনুশাসন ছিল অর্থের বিনিময়ে ধর্মগ্রহণ। দুঃখী – দরিদ্র্য মানুষকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করার রীতি প্রচলিত ছিল। তখন মার্গারেটের মনে প্রশ্ন জাগে ধর্ম কি এমন সংকীর্ণ যা অকপটে সবাই গ্রহণ করতে পারে না। তার এই হৃদয় উদবেলিত মন সমাজসেবাায় উদার মানসিকতায় বিকশিত হয়।১৮৯০ সালে লন্ডনে ডিলিউ এর সাথে একযোগে শিক্ষার জন্য স্কুল করলেও ডিলিউয়ের প্রচন্ড স্বাধীনচেতা মনোভাব থাকার জন্য তাঁর সাথে কাজ বেশি দিন করতে পারেননি। এরপর লন্ডনের সেমি ক্লাবে যোগদান করে যুক্তির দিক থেকে তুখর হয়ে ওঠেন তিনি। প্রাণহীন যুক্তির একেবারেই পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। ১৮৯৫ সালে স্বামীজি আমেরিকার ধর্ম প্রচার সেরে লন্ডনে হিন্দু ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যান। ১৬ই নভেম্বর মার্গারেটের সাথে দেখা হয় স্বামীজীর।” প্রত্যেক ধর্মই শ্রেষ্ঠ প্রত্যেক ধর্মেই সত্য বিরাজমান” – ধর্ম সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের এই যুক্তি মার্গারেটের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ১৮৯৬ সালে তিনি দ্বিতীয়বার লন্ডনে যান। শিকাগো ধর্ম মহাসভায় মার্গারেটের উপস্থিতি কাম্য করেছিলেন এবং মার্গারেট ও সেখানে সামিল ছিলেন। তাঁর অনুশীলন ধর্ম, যুক্তি একনিষ্ঠতায় বিবেকানন্দ অভিভূত হয়েছিলেন। পরে ধর্মীয় মহাসভায় এরকমও শোনা গেছে মার্গারেটের অনুপস্থিতিতে কোন ধর্মীয় যুক্তি রাখতেন না।পরাধীন ভারতের নারীদের জন্য দরকার শিক্ষা। সেই সময় নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ভারতে আসার জন্য মার্গারেটকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। ”কর্মে যদি কখনো বিরক্তি আসে তা তুমি আমাকে বলতে পারো, তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ করো আর না করো বেদান্ত ধর্ম গ্রহণ করো আর না করো তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে”। এরপর মার্গারেট ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কলকাতা পোর্ট বন্দরে জাহাজ ঘাটে এসে দাঁড়াতেই দেখলেন স্বামীজি স্বয়ং তাঁকে জাহাজ ঘাট থেকে নিতে এসেছেন।চৌরঙ্গী পাড়া থেকে পুরনো কলকাতার চিত্র ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে বাগবাজারে ১৬ নম্বর লেন বোস পাড়ায় গঙ্গার কাছে পুরনো একটি বাড়িতে তিনি ছিলেন। তিনি বলেছিলেন এইগুলি আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। পাশাপাশি মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ গুলির প্রগতিশীল হতে তাঁকে সাহায্য করেছে। ১৮৯৪ সালের ১৮ই মার্চ ব্রহ্মচর্যের দীক্ষাদানের মাধ্যমে হয়েছিলেন নিবেদিতা- তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেছিলেন বলে স্বামীজী তাঁকে বলেছিলেন ‘নিবেদিতা’। নারীজাতির যুক্তির জন্য তিনি বাগবাজারে ১৬ নম্বর বোস পাড়া লেনে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তখন নিবেদিতা বাড়ি, বাড়ি গিয়ে নারী শিক্ষার জন্য সবাইকে ডেকে বলতেন ”ওঠো না ওঠো জাগো তোমরা, বলোনা আমরা মেয়ে দিতে রাজি আছি”। ঐসময় খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে অপমান সয়ে কতগুলো মেয়ে জোগাড় করেছিলেন। তাদেরকে নিয়ে আঁকা, হাতের কাজ, সেলাই, লেখাপড়া শিখিয়ে ছিলেন। এই সময় স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী অভয়ানন্দ তাঁকে সাহায্য করতেন। আগে বিদ্যালয়টি ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ নামে পরিচিত ছিল। পরে ‘নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত হয়। তখন মা সারদা বলেছিলেন, ”আমি আশীর্বাদ করছি এখান থেকে যে মেয়ে পাঠ করবে সে আদর্শ বালিকা হয়ে উঠবে”। ভারতে সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সারা জীবন তিনি ভারতের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। মানব সেবাই ছিল তাঁর অন্যতম আদর্শ। স্বামী বিবেকানন্দের আলোচনা ও আধ্যাত্মিকতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও তিনি একাধারে সংগ্রামী ও সন্ন্যাসিনী ছিলেন।কলকাতায় প্লেগ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে অনেকে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। ক্রমশ মানুষের মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। সেইসব দুর্গত মানুষের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে প্রচুর সেবা করেছিলেন। স্বামী সদানন্দ, নিত্যানন্দ, স্বামী অভয়ানন্দ তাঁকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। নিবেদিতার এই কাজকে সমর্থন করে যতীন দাস – বাঘাযতীন এর মতন ছাত্র যুবকরা এগিয়ে এসেছিলেন।
বিবেকানন্দ তখন কাশ্মীরে সংস্কৃত কলেজ করার সিদ্ধান্ত জানালে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং সংস্কৃত কলেজ করার জন্য জায়গা দিতে প্রস্তুত থাকলেও ব্রিটিশ শাসক এর বিরোধিতা করে। কালী ভাবে তীব্র মাতৃ ভাবনার মধ্যে দিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘কালী দি মাদার’। তিনি ধর্ম ও সাহিত্য নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন তাঁর রচিত বই ভারতীয় মানব সেবায় অনির্বাণ শিক্ষা ছিল তাঁর কাছে তাই ঋষি অরবিন্দ তাঁকে বলেছিলেন ‘শিক্ষাময়ী’। আবার তাঁকে ‘ লোকমাতা’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন নিবেদিতা। ১৯০৬ সালে বেনারস কংগ্রেসের অধিবেশনে ব্রিটিশ বিরোধী ভাষণ ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলায় অনুশীলন সমিতির সঙ্গে বিশিষ্ট ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিদেশি পণ্য বর্জনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বহু বিপ্লবীকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে ব্রিটিশ শাসকের চোখে তিনি ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ হয়েছিলেন। বিপ্লবী অরবিন্দের গ্রেপ্তারের পর ‘সান্ধ্য’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন নিবেদিতা। ব্রিটিশ শাসকের বিদ্রোহের জন্য বিভিন্ন জায়গায় সমিতি গঠন হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে একত্রে বারীন ঘোষ কে সাথে নিয়ে অনুশীলন সমিতির নামকরণ করেছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদে বিদ্রোহ দেখা দিলে বিপ্লবীদের পাশে থেকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিলেন তিনি। অত্যধিক পরিশ্রমের জন্য ১৯১১ সালের ১৩ই অক্টোবর দার্জিলিঙে তাঁর মৃত্যু হয়।তিনি দেখতে চেয়েছিলেন পরাধীন মানুষের মুক্তির সূর্য। ভারতে নারীমুক্তির উজ্জ্বল ঊষালগ্ন ছিলেন নিবেদিতা।” প্রতিটি বৃক্ষ লতাগুল্মের প্রাণ আছে” – আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণা এবং বই এর ক্ষেত্রেও অনেক সাহায্য করেছিলেন নিবেদিতা। তাই তাঁর মৃত্যুর পর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং তাঁর পত্নী অনিলা বসুও বলেছিলেন, ‘নিবেদিতা হলেন লেভি অফ দ্য ল্যান্ড’। তিনি বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, উল্লাস কর, যতীন্দ্রনাথ, বারীন ঘোষ, বটুকেশ্বর দত্ত প্রমূখ বিপ্লবী নেতাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। তাঁর সম্পূর্ণ মানবসেবা চিরকাল ভারতবাসীর প্রেরণা হয়ে থাকবে।

About Author

[DISPLAY_ULTIMATE_SOCIAL_ICONS]

Advertisement