বেবি চক্রবর্ত্তী
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে লন্ডনে এক পারিবারিক আসরে মার্গারেট স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যা শুনতে আসতেন। বিবেকানন্দের ধর্মব্যাখ্যা ও ব্যক্তিত্বে তিনি মুগ্ধ এবং অভিভূত হন। তার প্রতিটি বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তরের আসরে উপস্থিত থাকতেন। তারপর বিবেকানন্দকেই নিজের গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি স্বদেশ ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মার্গারেট চলে আসেন ভারতে। এই সময় বিবেকানন্দের কাছে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, সমাজতত্ত্ব, প্রাচীন ও আধুনিক মহাপুরুষদের জীবনকথা শুনে মার্গারেট ভারতকে জানেন। ভারতে আসার কয়েক দিন পর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের পত্নী সারদা দেবীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। এরপর ২৫ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িতে তাকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন।

একদিন সন্ধ্যায় সময় গঙ্গার তীরে গুরু ও শিষ্যা বসে আছেন। বিবেকানন্দ বললেন ‘ যদি তোমাকে ভারতের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হয় তবে তোমাকে সম্পূর্ণ ভারতীয়ভাবে চলতে হবে। এমনকি আহার – বাহার, চাল – চলন, পোষাক – পরিচ্ছেদ, আচার – ব্যবহার, কথাবার্তা প্রত্যেক বিষয়েই হিন্দু ভাবাপন্ন হতে হবে। তোমার উপর যখন মেয়েদের শিক্ষার ভার দেব বলে ঠিক করেছি, তখন তোমাকে হিন্দু বিধবার মতন সম্পূর্ণ নিষ্ঠাবতী ব্রহ্মচারিণী হয়ে জীবন – যাপন করতে হবে। তোমার কাজ ক্ষুদ্র পারিবারিক ক্ষেত্রের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে সমগ্র জাতি ও দেশের প্রতি ব্যাপ্ত হবে। ভেবে দেখো তুমি তা পারবে কি…… না?নিবেদিতা বললেন, ‘ আমি পারবো ‘।
স্বামীজি লক্ষ করলেন তাঁর বলবার ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে প্রত্যয় ও দৃঢ়তা।অমৃতের আহ্বানে ভারতের নারী যুগে যুগে যেমন সর্বস্ব ত্যাগ করেছে, তুমি সেইরকম পারবে কি না ?আবার দৃঢ় কন্ঠে নিবেদিতা বললেন, ‘ পারব।’উত্তম। কিন্তু তোমার অতীত জীবনটাকে সম্পূর্ণ ভুলতে হবে, এমনকি তার স্মৃতিটুকু পর্যন্ত রাখতে পারবে না।নিবেদিতা আবার দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিলেন, ‘ পারব।’ সেদিন নিবেদিতার চোখে ছিল মধুর সারল্য আর অন্তরে প্রবল অনুরাগ। সময়টা ১৮৯৮ সালের ১৬ মার্চ। বিবেকানন্দ মার্গারেট নোবেলকে ব্রহ্মচারিণী ব্রতে দীক্ষিত করলেন। গুরু তাঁর নতুন নামকরণ করলেন -‘নিবেদিতা।’ এরপর তাঁর কপালে এঁকে দিলেন নতুন পরিচয়—— ‘ ভগিনী নিবেদিতা।’ বিবেকানন্দ যে দৃষ্টিতে ভারতবর্ষকে দেখতেন এখন থেকে নিবেদিতাও সেই দৃষ্টিতে ভারতবর্ষকে দেখতে আরম্ভ করলেন। মনের যে আবেগ নিয়ে বিবেকানন্দ ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন। এখন থেকে নিবেদিতা সেই আবেগেই অনুপ্রাণিত হলেন। গুরুর চিন্তার সঙ্গে নিজের চিন্তাকে একেবারে মিলিয়ে দিলেন। নিবেদিতা গৈরিকধারিণী ছিলেন না। স্বামীজি তাঁকে এক টুকরো গেরুয়া কাপড় দিয়েছিলেন তা তিনি নিত্য ধ্যানের সময় মাথার ওপর চাপা দিতেন।কখনও কখনও নিবেদিতার পরনে লাল ডুরে গাউন বা ঘাগড়া থাকত-অনেকের কাছে তা গেরুয়া বলে মনে হত। স্বামীজির দেহান্তের পরেও নিবেদিতা কোনও দিন পুরোদস্তুর গেরুয়া পোশাক ধারণ করেননি। কখনও কখনও সভায় বক্তৃতা দিতে হলে পাতলা একটি যা মাথার উপর দিয়ে পরতেন তার রং অনেকটা ফিকে কমলালেবুর মতো। গেরুয়া বলে অনেকেরই ভ্রম হতে পারে। তবে নিবেদিতার অন্তর বৈরাগ্য ও ব্রহ্মচর্যের কথা স্মরণ করে তাঁকে গৈরিকধারিণী বললে ভুল বলা হবে না।১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের পর সেই ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধনকে ছিন্ন করে ভারত নামক এই মহান দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করার ঘটনাক্রম যেমন বেশ চমকপ্রদ, তেমনি সে ইতিহাসটিও বড় শিক্ষনীয়।দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষয়টি কম আলোকিত একটি অধ্যায়।ভারতের জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করা চরমপন্থী নেতা অরবিন্দ -প্রমথনাথের ভাবশিষ্যা হওয়া সত্ত্বেও গোখলের মত নরমপন্থীদের সম্মিলিত করার মধ্য দিয়ে অখন্ড ভারতবর্ষের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার হদিস আমরা খুব কম জনই রাখি। রজনীকান্তের “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই” উত্তাল সময় শুরুর কালে বিলেতি দ্রব্য বর্জনের আন্দোলন অগ্রগন্যা ছিলেন এই বিদেশিনী। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করার নেপথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নিবেদিতার। পরাধীন ভারতের প্রথম সবচেয়ে বড় আন্দোলন-জমায়েত ছিল ১৯০৬ সালের ৭ই আগষ্টে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কলকাতা টাউন হলের সভা। সেদিনের সেই সভায় হিসেবের বাইরে এত মানুষের জমায়েত হয়েছিল যে, একটি মিটিং ভেঙে তিনটি স্থলে মিটিং এর আয়োজন করতে হয়েছিল।বিপ্লব (প্রতিবাদ) কথাটার প্রথম জন্মদাত্রী ভগিনী নিবেদিতা। আর প্রথম অনুশীলন সমিতির প্রথম পিলার ছিলেন নিবেদিতা। বাঘা যতীন, যতীন দাশ। ক্ষুদিরাম বসু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সহিংস ধারার অগ্রগন্য ছিল গুপ্ত সমিতি এবং অনুশীলন সমিতি। বাংলার বাইরে গুজরাটে প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সমিতি অরবিন্দের হাত ধরে বাংলায় আসে নিবেদিতার সক্রিয় অংশগ্রহণে।সালটা ১৯০২। প্যারিসে গিয়ে মেদিনীপুরের হেম কানুনগোর বোমা বানানোর কৌশল শিখে আসা কিংবা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপ্লবীদের জন্য রসায়ন গবেষণাগার খুলে দেওয়া এবং বিপ্লবীদের পয়সা দিয়ে সাহায্য করতো আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ফুলুর ছদ্মবেশে বিপ্লবী ছিল এর নেপথ্যে নিবেদিতার ভূমিকার কথা কোথাও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয় না। বিবেকানন্দের ভাবশিষ্যা নিবেদিতা স্বামীজীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিবেকানন্দ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দক্ষিণ ভারতের সীমাবদ্ধ কতকগুলি অঞ্চল ছাড়া কেন বেশিদূর এগোয়নি সে প্রসঙ্গ অন্য। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁর এই উদ্যোগে অংশ নেননি, সংক্ষিপ্ত ক্ষেত্রে স্বামী সদানন্দের অংশগ্রহণ ছাড়া। রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে মুক্ত থাকতে না চাওয়ায় নিজের ধর্মমত ও আদর্শের রামকৃষ্ণ মিশনকে পরিত্যাগ করার সুদীর্ঘ ইতিহাস আজ জাতীয়তাবাদ ও অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন-সাধনা। ভগিনী নিবেদিতা তাঁর জীবন-দর্শনে আজীবন যাপনে শুধু ধর্ম নয়, বরং ভারত মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিশ্চিত ও বন্ধুর পথকে। নিবেদিতাকে রামকৃষ্ণ মঠ ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছিল তবে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও মঠের অন্যান্য সন্নাসীরদের বিরূপ মনোভাব ছিল ”লেখ যে, তুমি স্বেচ্ছায় মঠ ছাড়িয়া যাইতেছ।” কারণ মঠ ছিল আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান সাধনা ক্ষেত্র। রাজনৈতিক ভাবধারাকে প্রাধান্য দেওয়া নয়। এই সময় নিবেদিতা পুলিশের চোখে ব্ল্যাক্ লিস্ট হয়েছিলেন। মঠের ভিতর পুলিশ হানা দেওয়া শুরু করলে সংঘ বাঁচাতে স্বামী ব্রহ্মানন্দ বাধ্য হয়েছিলেন। সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠিত ডন পত্রিকা ও ডন সোসাইটি, সন্ধ্যা পত্রিকা, যুগান্তর পত্রিকা, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মডার্ন রিভিউ পত্রিকা, বিপিনচন্দ্র পালের স্বরাজ পত্রিকা প্রভৃতি সংবাদপত্রে তাঁর বিখ্যাত লেখনি যেমন একদিকে তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে সাহায্য করে; সেই সঙ্গে হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদ একে অপরের পরিপূরক তার প্রতিচ্ছবি আজকের ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশের বিশ্লেষণ করতে শেখায়। ঠিক একইভাবে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করা ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের হিন্দু ধর্মের প্রতি চুড়ান্ত আনুগত্য ও হাবার্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু দর্শন প্রচারের নেপথ্যে খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী এক বিদেশিনীর ভূমিকা অনেকগুলি ভ্রম সংশোধনের রাস্তা খুলে দেবে। “বিবেকানন্দের জলন্ত চিতা হইতে যে দুইটি অগ্নিশিখা বাহির হইয়া আসিয়াছিল, তার একটি ভগিনী নিবেদিতা, আর একটি উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব। এই দুইটি যমজ অগ্নিশিখা কে কখনও পৃথক করিয়া কখনও বা একত্র করিয়া দেখিলে বাংলার স্বদেশী যুগকে পুরাপুরি দেখা যাইবে।” মদনলাল ধিংরা কতৃক লন্ডনে ১৯০৯ সালে কার্জন উইলি হত্যা এবং সুদুর আয়ারল্যান্ডে তার সমর্থন ও উদযাপনে নিবেদিতার ভূমিকার অসম্পূর্ণ চর্চা ভারতের সহিংস আন্দোলনের খন্ডিত চিত্রের উপস্থাপন করে। প্রখ্যাত চিত্রকর ওকাকুরা’র শিল্প ভাবনায় জাপানি চিত্র আদর্শের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের ভারতীয় শিল্পনীতির অভূতপূর্ব সমন্বয়ের কিংবা অজন্তার চিত্রকলার বিশ্লেষণে নন্দলাল বসু ও শিল্পী অসিতকুমার হালদারের সহায়তায় রেপ্লিকা চিত্র তৈরীর উদ্যোগের কারিগর ভগিনী নিবেদিতা কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার অবকাশ আছে। সেইসঙ্গে ভারত আত্মা এবং অখন্ড ভারতের প্রতিভু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ভারতমাতা’ র চিত্র যে নিবেদিতার ভাবনার প্রকাশ তা শিল্পী নিজেই তাঁর গ্রন্থ ‘ জোড়া সাঁকোর ধারে’ তে উল্লেখ করেন।১৯৪৭ সালে ১৫ ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুটি পৃথক ডমিনিয়নের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। ভারত অপরটি পাকিস্তান। সেখানে ছিল কোটি মানুষের রক্তে এবং চোখের জলে ছিল দেশভাগ। চিরকাল হিংসা বিদ্বেষ জিইয়ে রাখতে স্বামীজির দেখা সেই অখন্ড ভারতবর্ষ যেন মাতৃভূমি দ্বি-খন্ডিত হয়ে আজ কল্পনায় বিরাজমান।একটি ভারত – পাকিস্তানের পারস্পরিক ঠান্ডা লড়াই। চব্বিশ ঘন্টা যেখানে প্রহরায় নিজস্ব সীমান্ত রেখা বরাবর সেনা মোতায়েন করা। সেই অখন্ড ভারতবর্ষ মানচিত্র টা যেন পাখনা মেলা পাখির ডানার মতো। আজও যেন অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। এই স্বাধীনতার সূর্যদ্বোয় দেখতে চাইনি যেখানে হিংসা বিদ্বেষ জর্জরিত পরাধীনতার গ্লানি। এ আমাদের কাছে লজ্জার বর্তমানে এই অখন্ড ভারতবর্ষ যেন কল্পনায় বিরাজমান।