বিলুপ্তির পথে সন্দেশের ছাঁচ তৈরির শিল্প
বেবি চক্রবর্ত্তী

বাংলার সংস্কৃতি ও খাদ্য ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন সন্দেশ। শুধু স্বাদের জন্য নয়, নান্দনিক শিল্পকলার এক বর্ণময় প্রকাশ ছিল এই মিষ্টির ছাঁচে গড়া চেহারা। এক সময় কাঠ, মাটি, ধাতু বা পাথরের তৈরি নানান ছাঁচে ঢেলে তৈরি হতো দেব দেবীর মূর্তি, ফুল, পাতা, প্রাণী চিত্র বা লোক কথার কাহিনী চিত্রে অলংকৃত সন্দেশ। তবে আজ এই ছাঁচ তৈরি শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।শিল্পীদের হাতে তৈরি এই ছাঁচে খাঁটি বেল কাঠ, পোড়ামাটি বা ধাতব বস্তু ব্যবহার করে খোদাই করা হতো। প্রতিটি ছাঁচ তৈরি হতে সময় লাগতো ঘন্টার পর ঘন্টা।প্রধানত মিষ্টির দোকানে এর ব্যবহার দেখা গেলেও এর জন্ম হয়েছিল কিন্তু বাংলার একেবারে অন্দরমহলে। প্রাচীন বাংলার বিশেষত নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, কলকাতা ও বাঁকুড়া অঞ্চলে এই ছাঁচ নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠেছিল।তিন ধরনের ছাঁচ দেখতে পাওয়া যায়। মাটির পাথরের আর কাঠের। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই ১৮০০ শতকের মাঝের দিকে ব্যবহার হতে থাকে এই ছাঁচ। কাঠ ও পাথরের ছাঁচ খোদাই করে তৈরি হয়। কিন্তু মাটির ছাঁচ বানানোর পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম। প্রথমে উপযুক্ত মাটি পরিমাণ মতো নিয়ে সেটার ডিজাইনটা বানিয়ে নিতে হয়। তারপর সেটাকে রোদে শুকিয়ে তার ওপর আরেক দফা অন্য একটি মাটির প্রলেপ চাপিয়ে নেওয়া হয়। এই শুকনো ছাঁচ এবার আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া হয়। আর এই পোড়ানোর জন্য সবথেকে উপযুক্ত হল ঘুঁটের আগুন। এই ছাঁচের রং ঘন কালো করার জন্য নিভন্ত আগুনে প্রায় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ফেলে রাখা হয়। শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো হয়ে উঠেছিল একরকম খাবার মাধ্যমে কাহিনী বলার উপকরণ। একটা সময় ছিল যখন বাংলার ঘরে ঘরে মা বোনেরা ক্ষীরের বা ছানার সন্দেশ নারকেল সন্দেশ বানাতেন। তাদের হাতের অবসর সময়টা তারা বিভিন্ন গার্হস্থ শিল্পকলায় ব্যবহার করতেন। এর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল এই ছাঁচ শিল্পের। তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাকে ছাঁচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গোটা মাছের সন্দেশ, ফুলশয্যার সন্দেশ, গায়ে হলুদের সন্দেশ আগে যেমন ব্যবহার করা হতো এখনো সেই সব সন্দেশ চোখে পড়ে। এছাড়াও বিভিন্ন পশু পাখির ছাঁচ, পট-চিত্রের আদলে সন্দেশের ছাঁচ এইসব নানা রকম ছাঁচ তখন জনপ্রিয় ছিল। এই ছাঁচ তৈরির জন্য এক সময় ব্যবহার করা হতো দেশি বেলকাঠ, যা বেশ টেকসই এবং খোদাই করার জন্য উপযোগী। দক্ষ শিল্পীরা নির্দিষ্ট ধারালো হাতিয়ার দিয়ে নকশা কাটতেন ছাঁচে। এক একটি ছাঁচ তৈরি করতে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনকি কয়েক দিন সময় লাগতো। এই কাজের জন্য অসীম ধৈর্য, নিখুঁত মাপ, তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়। প্রতিটি কাজ মনসংযোগ দিয়ে করার পর আয় হয় সামান্য। এই জন্য পরবর্তী প্রজন্ম বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এই কাজ আর শিখতে চাইছেননা। পাশাপাশি ক্রেতাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। আর সরকার বা সংস্থার তরফেও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। ফলে যারা এখনো এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তারাও আজ এই পেশা বদলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে কারিগরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়া আধুনিক মেশিনে তৈরি মোল্ড এবং প্লাস্টিক ছাঁচের দাপটে এই প্রাচীন শিল্প ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।মিষ্টির বা সন্দেশের ছাঁচ প্রাচীন বাংলার এক লোকশিল্প। সুস্বাদু মিষ্টান্নকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলাতেই শিল্পীর মুন্সিয়ানা। বর্তমানে হরেক ছাঁচের মিষ্টির দেখা মেলে শুধু মিষ্টির দোকানেই। একসময় বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হতো মিষ্টির ছাঁচ। শুধু মিষ্টি নয় – আমসত্বের ছাঁচ, আস্কে পিঠের ছাঁচ সহ বিভিন্ন ছাঁচ তৈরিতে বাড়ির মেয়ে বউরা সিদ্ধহস্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই ধরনের ছাঁচের তৈরি মিষ্টির রমরমা বাজার একটা সময় থাকলেও এখন আজ আর নেই। এইরকমই মনে করছেন মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকরা। তাঁদের কথায় উঠে আসে “আগে প্রতি পুজোয় বা বিশেষ অনুষ্ঠানে মন্ডলাকৃতি বা কৃষ্ণ লীলার দৃশ্য সহ সন্দেশের অর্ডার থাকতো এখন শুধুই বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা – নকশা নয় মুনাফা”। এছাড়া অন্যান্য কারিগররাও জানিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্ম প্রায়শই এই শিল্পী আগ্রহ দেখাচ্ছে না- কারণ কঠোর পরিশ্রম আর কম মুনাফার ফাঁদে কেউ পড়তে চায় না। তবে আশার আলো জ্বলছে কিছু ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গ হস্তশিল্প মেলা বা কয়েকটি সরকারি প্রকল্পে এই ছাঁচ গুলিকে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু সংগ্রাহক ও হেরিটেজ হোটেল সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পুরনো ছাঁচ কিনছেন। তবুও শিল্পের স্থায়ী রক্ষাকবচ হতে হলে আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন। এছাড়াও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সচেতনতা গড়ে তোলা খুবই দরকার। সন্দেশ শুধু বাংলার মুখরোচক উপকরণ নয়, বরং এটি আমাদের ইতিহাস, শিল্প এবং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবির কাঠামো গড়ে তোলার কারিগররা যদি হারিয়ে যান তাহলে হারাবে এক অমূল্য ঐতিহ্য। তাই বিলুপ্তির আগেই আমাদের জেগে ওঠার সময়। দরকার এই শিল্পকে বাঁচানোর সচেতন উদ্যোগ- সরকার, সমাজ, সংস্থা ও বাজারকে একত্রে পথে নামতে হবে। নইলে একদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু বইয়ের পাতাতেই জানবে “সন্দেশে নাকি এককালে ছবি ফুটে উঠত..” সন্দেশ শুধু বাংলার খাদ্য নয় – এটি আমাদের নন্দনচেতনা ও ইতিহাসের অংশ। সেই ইতিহাসের ধারক ছাঁচ তৈরির শিল্প যদি নিঃশেষ হয়ে যায় তবে বাংলার সংস্কৃতির এক অমূল্য অধ্যায় চিরতরে হারাবে।