প্রচুর জলাভূমি: বারুইদের বসবাস ছিল প্রাচীন জনপদ বারুইপুর

IMG-20250728-WA0097

বেবি চক্রবর্ত্তী

দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ঐতিহ্যপূর্ণ বারুইপুরে একসময় প্রচুর জলাশয় ছিল। যাকে এককথায় জলাভূমি বলা যায়। এটি ছিল স্বনির্ভর কৃষিভিত্তিক অঞ্চল। বারুইপুর নামটি “বারি” বা জল থেকে এসেছে এই যুক্তির সমর্থনে বলা যায়। এই অঞ্চলে একসময় প্রচুর জলাশয় ছিল। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় জলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। “বারুই” বা পান থেকে নামকরণ।পাশাপাশি একসময় এই অঞ্চলে প্রচুর পানের চাষ হতো এবং পান এখানকার মানুষের জীবিকার একটি প্রধান অংশ ছিল। এখানে নীলচাষের একটি আদি কেন্দ্র ছিল। ১৮৮২ সালে শিয়ালদা থেকে বারুইপুর পর্যন্ত বাষ্পচালিত ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল। যা এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল। উনিশ শতকে একটি লবণগোলাও তৈরি হয়েছিল। ১৮৫৮ সালে বারুইপুর একটি মহকুমায় পরিণত হয়। এর আগে এটি একটি মহকুমা বিভাগের অংশ ছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে একজন সংগ্রাহকের অধীনে কর আদায়ের জন্য তৈরি একটি মহকুমা ছিল। জমিটির উত্তরে সোনারপুর, দক্ষিণে জয়নগর, পূর্বে ক্যানিং এবং পশ্চিমে বিষ্ণুপুর অবস্থিত।প্রাচীনকাল থেকে ষোড়শ শতক অবধি আদি ভাগীরথী খালের পাড়ে অনেক জনপদ গড়ে উঠেছিল। কালীঘাট – বোড়াল- রাজপুর – হরিণাভি – মাহিনগর- বারুইপুর – বাহারু – জয়নগর মজিলপুর – ছত্রভোগ ইত্যাদি। ১৪৯৫ সালে রচিত বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসবিজয় এই অঞ্চলের অনেক স্থানের উল্লেখ করে। ” মনসবিজয়ের একজন বণিক চরিত্র চাঁদ সদাগর কালীঘাট থেকে পুরাতন ভাগীরথী খাল দিয়ে বারুইপুরে পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে তিনি ছত্রভোগের দিকে অগ্রসর হন এবং তারপর হাতিয়াগড় পরগনা দিয়ে খোলা সমুদ্রে পৌঁছান”। এরপর চৈতন্যদেব ১৪৮৬ সাল থেকে ১৫৩৪ সালে এই পথ দিয়ে যান। নৌকায় পুরীতে ভ্রমণ করার সময় তিনি বারুইপুরের কাছে আতিসার গ্রামে যাত্রা করেন। এই দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তাঁর শেষ যাত্রাবিরতি ছিল ছত্রভোগে। বর্তমানে মথুরাপুর থানার আওতাধীন একটি গ্রাম । ছত্রভোগ পুরাতন ভাগীরথী খালের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল বলে মনে হয়। ছত্রভোগের জমিদার রামচন্দ্র খান চৈতন্যদেবকে তাঁর যাত্রা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছিলেন। ১৪৯৫ সালে মনসামঙ্গল কাব্যে বণিক চাঁদ সদাগর পুরাতন ভাগীরথীর খাল দিয়ে বারুইপুর আসেন। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব নৌকায় পুরীতে ভ্রমণের সময় বারুইপুরের কাছে অতিশয় গ্রামে যাত্রা করেন। ছত্রভোগে তাঁর শেষ বিরতি যাত্রা ছিল। এই ছত্রভোগ ছিল পুরাতন ভাগীরথী খালের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। বর্তমানে মথুরাপুর থানার আওতাধীন একটি গ্রাম। এই ছত্রভোগর জমিদার রামচন্দ্র খান মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে তাঁর যাত্রা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছিল)বারুইপুরের গজন উৎসব বিখ্যাত। কথিত ছিল একবার বরিশালের সাবর্ণ চৌধুরীর ল্যাথিয়াল এবং বারুইপুরের রায় চৌধুরীর ল্যাথিয়ালদের বিরুদ্ধে লঘু লড়াইয়ের সময় তাদের নিজ নিজ জমিদারদের সীমানার বিরোধ নিয়ে সংঘটিত হয়। সারেরান রায় চৌধুরীর ল্যাথিয়ালদের সরদার ছিলেন ভিরুগুরাম। বারুইপুরের ল্যাথিয়ালস তার মাথাটি তলোয়ার দিয়ে কাটাতে এবং লড়াই জিতে নেয়। অন্যদিকে ভুরুঙ্গামের এতটাই সম্মান ছিল যে তার চুলের লক সংরক্ষণ করা হয়েছিল। ভ্রূণুরামকে প্রকাশ্যে এখনও সম্মানিত।বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় থেকে এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম এবং নগরের তালিকা পাওয়া যায়। শ্রী চৈতন্যদেব ভাগিরথীর পার ধরে পুরি যাওয়ার পথে বারুইপুরের কাছে আটসিরাতে এবং সর্বশেষ মথুরাপুরের ছত্রভোগে থেমেছিলেন।১৫৩৮ সালে পর্তুগীজরা গৌরের শেষ ইলিয়াস শাহি সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদের থেকে সরস্বতী এবং ভাগীরথী-হুগলির সংযোগস্থলে অবস্থিত সাতগাঁওতে বসতি গড়ার অনুমতি পায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় গড়িয়ায় পূর্বে বিদ্যাধরী নদীর তীরে তার্দা বন্দরে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা প্রথম ঘাঁটি গাড়ে। এরপর এই সময়ে বাংলায় মুঘলদের বিরুদ্ধে বারো ভুইয়াঁদের মিত্রশক্তি হয়ে ওঠে পর্তুগীজরা এবং নদী তিরবর্তী অঞ্চলে তাদের জলদস্যুতা বজায় রাখতে থাকে। পরবর্তি ১০০ বছর তাদের আধিপত্য বজায় ছিল উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে। এর ফলে এই অঞ্চলে অনেক সমৃদ্ধশালী জনপদ জনশূন্য হয়ে যায়। ১৭ শতাব্দীর শুরুতে বাংলার বারো ভুঁইয়ার (১১ ভুঁইয়া ও ১ মুঘল সম্রাট) একজন যশোররাজ প্রতাপাদিত্য যশোর – খুলনা – বরিশাল সহ গোটা ২৪ পরগনা জেলার অধিপতি ছিলেন। প্রতাপাদিত্য পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সাগরদ্বীপ, সরসুনা, জগদ্দল প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্গ বানিয়ে এদের আটকাবার চেষ্টা করেন ও বিতাড়িত করতে সক্ষম হন৷ ১৮৯০ সালে সুন্দরবন সফরকারী এক ইংরেজ সাহেব রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজপুরীর ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান।১৬১০ সালে সলকা ও মগরাহাটের যুদ্ধে মুঘল সেনাপতি মান সিংহের হাতে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন। মান সিংহ ছিলেন কামদেব ব্রহ্মচারীর শিষ্য। কামদেবের বংশধর হালিশহরের জায়গিরদার লক্ষীকান্ত মজুমদারকে ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর মাগুরা, পাইকান, আনোয়ারপুর, কলকাতা ইত্যাদি একুশটি অঞ্চলের জমিদারি স্বত্ত্ব দেন। প্রতাপাদিত্য যখন রাজা বসন্ত রায়কে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন তখন থেকে প্রতাপাদিত্যের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত। লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের নাতি কেশবচন্দ্র মজুমদার মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে বর্তমানের দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও খুলনা অঞ্চলের জমিদার নিযুক্ত হন।১৭২২ সালে মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ে মোগল আমলের শেষ জরিপে ওই পরগনাগুলিকে হুগলি চাকলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পলাশীর যুদ্ধের ছয় মাস পরে ১৭৫৭ সালে ২০শে ডিসেম্বর মীরজাফর ইংরেজদের কলকাতা সহ দক্ষিণে কুলপী পর্যন্ত ২৪টি পরগনাকে কলকাতার জমিদারি বা ২৪ পরগনার জমিদারির নামে ৮৮২ বর্গমাইল এলাকা দান করেছিলেন।১৭৫৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লর্ড ক্লাইভকে এই ২৪টি পরগনা ব্যক্তিগত জায়গীর হিসাবে দেয়। এই সময়ে সুন্দরবনের এক বিস্তৃত অংশ ২৪ পরগনার মধ্যে ছিল না। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম জঙ্গল কেটে সুন্দরবন অঞ্চলে বসতি ও চাষ শুরু হয়। ১৭৭৪ সালে লর্ড ক্লাইভের মৃত্যুর পর এই অঞ্চলটি আবার কোম্পানির হাতে চলে আসে। লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ করার পর পরগনা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়।১৮২২ থেকে ১৮২৩ সালের মধ্যে বসতি ও চাষের জন্য সুন্দরবনকে লট ও প্লটে ভাগ করা হয়। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৮৫৫ সালের মহাকুমার ধারণাকে নিয়ে আসা হয় ও সমগ্র জেলাকে আটটি মহাকুমায় ভাগ করা হয়। নতুন মহাকুমার সৃষ্টি বা অদলবদলও এরপরে ঘটে। ১৮৭১ সালে কলকাতা ২৪ পরগনা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের রাজধানীতে পরিণত হয়।১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তান হবার পর যশোর জেলার বনগাঁ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে চলে আসে এবং সুন্দরবনের বৃহত্তম অংশ খুলনা ও বাখরগঞ্জের মধ্যে চলে আসে। ১৯৮৩ সালে ডঃ অশোক মিত্রের প্রসাসনিক সংস্কার কমিটি এই জেলাকে বিভাজনের সুপারিশ করে। ১৯৮৬ সালে ১লা মার্চ জেলাটিকে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা নামে দুটি জেলায় ভাগ করা হয়। দুটি জেলাই প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।১৯২৩ সালে বারুইপুরের দুই মাইল উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত গোবিন্দপুর গ্রামে দ্বাদশ শতাব্দীর সেন রাজা লক্ষ্মণসেনের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় খাড়ি গ্রাম দ্রষ্টব্য। এই তাম্রশাসন থেকে লক্ষ্মণসেন কর্তৃক গ্রামটি দান করার কথা জানা গিয়েছে। এই গ্রামেরই হেদোপুকুর নামে পরিচিত একটি পুরনো পুকুরের পাড়ে কারুকার্য শোভিত ইটের একটি স্তুপ দেখা যায়। গোবিন্দপুরের মাইলখানেক দক্ষিণে বেড়াল-বৈকুণ্ঠপুর গ্রামে প্রাচীন এক দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। আরও দক্ষিণে কল্যাণপুর গ্রামে একটি জীর্ণ প্রাচীন মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। যাঁকে রায়মঙ্গল কাব্যের ‘কল্যাণমাধব’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী লর্ড ক্যানিং তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নদী- বন্দর অঞ্চলে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলেছিলেন। এছাড়াও দক্ষিণ শাখায় শিয়ালদা থেকে ক্যানিং রেলপথ যোগাযোগ তৈরি করেছিল লর্ড ক্যানিং সাহেব।বারুইপুর শহরের কয়েক মাইল পূর্বে আটঘরা গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে মৌর্য যুগের মূর্তি ও মুদ্রা এবং পাল যুগের কিছু প্নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীন গবেষকদের মতানুসারে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এই স্থানটি ছিল একটি ইন্দো-রোমান বাণিজ্য কেন্দ্র তথা গঙ্গারিডি রাজ্যের প্রধান বন্দর নগরী। ফাঁসিডাঙায় বিশালাকায় জীবজন্তুর কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। এই মহকুমার বড়ো দিঘিগুলি থেকে শুঙ্গ, কুষাণ, পাল ও সেন যুগের কষ্টিপাথরের মূর্তি, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির পুতুল, মুদ্রা, লিপি ও সিলমোহর সহ নানা প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। দমদম ঢিবির কাছে মাটির নিচে প্রাচীন দুর্গের প্রাচীর আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই প্রাচীরের নিকটবর্তী ইটের ঘরের মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে পোড়ামাটির গোলাকার অস্ত্র ও ধাতুনির্মিত বর্শাফলক। এই মহকুমায় আদিগঙ্গার তীরবর্তী নবগ্রাম- রামনগর – সীতাকুণ্ড- পুরন্দরপুর- ধোপাগাছি-ধামনগর, কল্যাণপুর প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে যক্ষিণী মূর্তি, নানারকম মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির খেলনা, সিলমোহর, মাতৃকামূর্তি, স্বর্ণালংকার, নানাপ্রকার বাসনপত্র, হাতির দাঁত ও পাথরের বিভিন্ন ভাঙা ও অক্ষত মূর্তি, বিদেশি দানপাত্র, সোনা, রুপো ও তামার মুদ্রা প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে।বারুইপুর একটি প্রাচীন বর্ধিষ্ণু জনপদ। ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই কর্তৃক রচিত মনসার ভাসানে চাঁদ সদাগরের সিংহল যাত্রাপথের বর্ণনায় বারুইপুরের উল্লেখ পাওয়া গেছে। ‘কালীঘাটে চাঁদরাজা কালীকা পূজিয়া।চুড়াঘাট বাহিয়া যায় জয়ধ্বনি দিয়া।ধনস্থান এড়াইল বড় কুতূহলে।বাহিল বারুইপুর মহা কোলাহলে। হুলিয়ার গাঙ্গবাহি চলিত ত্বরিত।ছত্রভোগ গিয়া রাজা চাপায় বূহিত।।সন্ন্যাসী আনন্দগিরির পত্নী তারামণি দেবী বারুইপুরের আনন্দময়ী কালীবাড়ির অদূরে দেবী বিশালাক্ষীর একটি দারুবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনশ্রুতি তারামণি দেবীর সমাধি এই মন্দির প্রাঙ্গনে এবং আনন্দগিরির সমাধি রয়েছে আনন্দময়ী কালীবাড়ির সিংহাসনের নিচে পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর। মুঘল আমলে বারুইপুরের রায়চৌধুরী পরিবার মেদমল্ল পরগনার জমিদারি স্বত্ব পান। সেই সময় এই পরিবারের নিবাস ছিল রাজপুর গ্রামে। তিন লক্ষ তিন হাজার টাকা রাজস্ব দিতে না পারায় ১৬৭৬ সালে রায়চৌধুরী পরিবারের রাজা মদন রায়কে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে যান শায়েস্তা খাঁ। সেই সময় বাশড়ার জঙ্গলে মোবারক গাজি নামে এক দৈবশক্তিসম্পন্ন ফকির বাস করতেন। মদন রায় তাঁর শরণাপন্ন হলে ঢাকা দরবারে তিনি সসম্মানে মুক্তিলাভ করেন। কথিত আছে, মোবারক গাজি একটি বাঘ নিয়ে দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। এরপর মদন রায় গাজি সাহেবের মাহাত্ম্য প্রচার করেন। বর্তমানে ঘুটিয়ারি শরিফ স্টেশনের কাছে গাজি সাহেবের আস্তানা অবস্থিত। বারুইপুর সেই সময় ছিল জঙ্গলময় এলাকা। মদন রায়ের পৌত্র দুর্গাচরণ রায়চৌধুরী প্রথম বারুইপুরে বসবাস করতে আসেন। এরপর রায়চৌধুরীরা প্রচুর জমি দান করে বিভিন্ন বর্ণের মানুষকে সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দেন। ফলে স্থানটিও কিছুদিনের মধ্যেই জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেশ কিছু রাজস্ব ও প্রশাসন-বিষয়ক কার্যালয় চালু হয় বারুইপুরে। তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘নিমক মহল’ বা লবণ দফতর। নিমক মহলের অন্যতম সদর দফতর ও একজন মেডিক্যাল অফিসারের দফতর গড়ে ওঠে এখানে। নিমক মহলের এজেন্ট প্লাউডন ১৮২০ সালে এখানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২৩ সালে বিদ্যালয়টি মিশনারি স্কুলে পরিণত হয়। ১৮৪৬ সালে এই অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি গির্জা স্থাপিত হয়। ১৮৬৯ সালে বারুইপুর পুরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৮ সালে প্রথম বারুইপুর মহকুমা গঠিত হয়। ১৮৮৩ সালে সেই মহকুমা মিশে যায় আলিপুর মহকুমার সঙ্গে। এরপর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার গঠিত হয় বারুইপুর মহকুমা। বারুইপুর নামের নামকরণ নিয়ে দুটি প্রধান মত প্রচলিত আছে। জনশ্রুতি আছে “বারুই” শব্দের অর্থ সুপারি চাষী বা সুপারি ব্যবসায়ী। এই অঞ্চলে একসময় প্রচুর সুপারি চাষ হত। তাই এই অঞ্চলের নাম বারুইপুর হয়েছে বলে মনে করা হয়। অন্য মতে “বারু” শব্দের অর্থ পান। পান চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল এই অঞ্চল, তাই “বারুজীবী” বা পানচাষীদের বসবাস থেকে এই নামকরণ হয়েছে। বারুইপুর নামকরণের এই দুটি মতই যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। তবে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে “বারু” বা পান থেকে নামকরণ হওয়ার সম্ভবনা বেশি বলে মনে করা হয়। বারুইপুর একটি প্রাচীন জনপদ। এর নামকরণের ইতিহাসও বেশ পুরনো। মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য সাহিত্যকর্মে এই অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়।বারুইপুর হুগলি নদীর তীরে পুরাতন ভাগীরথী গঙ্গার ধারে অবস্থিত। এখানে একসময় প্রচুর পানের বরজ ছিল, যা এর নামকরণের যৌক্তিকতাকে সমর্থন করে। ষোড়শ শতকে এই অঞ্চলে কালীঘাট, বোড়াল, রাজপুর, মাহিনগর, বারুইপুর, বহরু, জয়নগর মজিলপুর প্রভৃতি জনপদ গড়ে উঠেছিল। অর্থনৈতিকভাবে বারুইপুর পেয়ারা, লিচু এবং অন্যান্য ফলের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও এখানকার তৈরি সার্জিক্যাল যন্ত্র সারা বিশ্বে রপ্তানি করা হয়।বারুইপুর নামকরণ এর পেছনে পান বা সুপারি চাষের ইতিহাস। এই অঞ্চলের প্রাচীতম নিদর্শন রয়েছে।

About Author

[DISPLAY_ULTIMATE_SOCIAL_ICONS]

Advertisement