নয়া দিল্লি: ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল একটা ফাটল থেকে, যা চোখে প্রায় পড়েই না, ফাটলটা ছিল একটা ফ্যালকম-৯ বুস্টারের প্রেশার ফিডলাইনের ওয়েল্ড জয়েন্টে। মহাকাশযানের বিপুল যন্ত্রপাতির মধ্যে একটা ছোট্ট ফাটল। কিন্তু ভারত তাকে উপেক্ষা করেনি। ইসরোতে আমাদের সদা সজাগ ও আপোষহীন বিজ্ঞানীরা সমাধান চেয়েছিলেন। তাঁরা যেমন তেমনভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান নি, মেরামতির উপর জোর দিয়েছিলেন, আর এর ফলে তাঁরা শুধু একটি মিশনকেই রক্ষা করেন নি, বাঁচিয়েছিলেন এক স্বপ্নকে। সেই স্বপ্ন ডানা মেললো ২০২৫ সালের ২৫ জুন, যখন ভারতীয় বায়ুসেনার আধিকারিক এবং ইসরোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহাকাশচারী গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা অ্যাক্সিয়ম-৪ মিশনের যাত্রী হয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করলেন। একদিন পরেই আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের সঙ্গে মহাকাশযানের ডকিং সম্পন্ন হল। তিনি হয়ে উঠলেন ভারতের পরবর্তী বিশাল লাফের মুখ – শুধু মহাকাশের ক্ষেত্রেই নয়, মানবকেন্দ্রিক বিজ্ঞান, ওষুধ এবং প্রযুক্তির ভবিষ্যতেরও।এটা কোনো আনুষ্ঠানিক যাত্রা ছিল না, এ ছিল এক বৈজ্ঞানিক ধর্মযুদ্ধ। শুক্লা তাঁর সঙ্গে মহাশূন্যে পরীক্ষা করার মতো সাতটি বিষয় নিয়ে গিয়েছিলেন। বহু পরিশ্রমে সেগুলি তৈরি করে দিয়েছিলেন ভারতীয় গবেষকরা। এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছিল, যা শুধু মহাকাশচারীদের জন্যই নয়, দেশজুড়ে আমাদের কৃষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার ও পড়ুয়াদের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।মহাকাশে মেথি ও মুগের বীজের অঙ্কুরোদগমের কথাই ভেবে দেখুন না। শুনতে সহজ, প্রায় কাব্যিক। কিন্তু এর প্রভাব গভীর। মহাকাশযানের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, যেখানে প্রতি গ্রাম পুষ্টির হিসেব রাখা হয়, সেখানে ভারতীয় শস্য মহাশূন্যে কেমন আচরণ করে, তা জানতে পারলে দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রায় মহাকাশচারীদের খাদ্য তালিকা নতুন করে তৈরি করা যেতে পারে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, এর থেকে পৃথিবীতে উল্লম্ব কৃষি ও জলবিদ্যা সংক্রান্ত উদ্ভাবন উৎসাহ পেতে পারে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলগুলিকে ভূমির অবক্ষয় ও জলসঙ্কটের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, সেগুলির ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।এছাড়া ছিল ভারতীয় টার্ডিগ্রেড – আণুবীক্ষণিক জীবাণু যা তাদের স্থিতিস্থাপকতার জন্য পরিচিত। মহাশূন্যে এদের বেঁচে থাকা, প্রজনন এবং জীনগত অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এদের আচরণ জৈবিক সহনশীলতার রহস্য উন্মোচন করতে পারে, যা টিকা তৈরি থেকে শুরু করে জলবায়ু উপযোগী কৃষিকাজ, সব কিছুতেই কাজে লাগবে।শুক্লা একটি মায়োজেনেসিস পরীক্ষাও করেছিলেন, মানব পেশীর কোষগুলি মহাকাশের পরিস্থিতি এবং পুষ্টি পরিপূরকের ক্ষেত্রে কেমন প্রতিক্রিয়া জানায়, তা পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। এর ফলাফল পেশীক্ষয়ের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে, যা থেকে কেবল মহাকাশচারীরাই নন, প্রবীণ ব্যক্তি এবং ট্রমার চিকিৎসায় থাকা ব্যক্তিরাও উপকৃত হবেন।এছাড়া সায়ানোব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে, এ এমন এক জীব যা একদিন মহাকাশে জীবনকে টিকিয়ে রাখতে পারে। ধান, মটর, তিল, বেগুন এবং টমেটোর মতো ভারতীয় শস্য মহাশূন্যে কেমন অবস্থায় থাকে তাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। এই বীজগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চাষ করা হবে, যা চরম পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো নতুন শস্য প্রজাতির জন্ম দেবে। এমনকি মানবদেহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়েও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। বিভিন্ন বৈদ্যুতিন প্রদর্শনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করার ক্ষমতার উপরে মহাশূন্য কেমন প্রভাব বিস্তার করে, তা জানতে শুক্লা ওয়েব ভিত্তিক মূল্যায়ন করেছেন। ভবিষ্যতের মহাকাশ কেন্দ্র এবং মহাকাশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি এই পরীক্ষা থেকে উঠে আসবে।এগুলি কোনো বিমূর্ত সাধনা নয়, এর মূলে রয়েছে ভারতীয় নৈতিকতা, যা সমাজের উপকারে বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে চায়। মহাকাশে অ্যাক্সিয়ম-৪ -এ চালানো প্রতিটি পরীক্ষা নিরীক্ষার পৃথিবীর মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে, সে তিনি ওড়িশার কোনো জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষক হোন বা শিলং-এর কোনো স্কুল পড়ুয়া অথবা লাদাখের কোনো চিকিৎসক। এই মিশন বিশ্ব মহাকাশ কূটনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের জোরাজুরির জন্যই স্পেসএক্স-কে তাদের ত্রুটি চিহ্নিত ও সংশোধন করতে হয়েছিল, যার ফলে সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে। নাসা, ইএসএ এবং অ্যাক্সিয়ম স্পেসের সঙ্গে আমাদের যৌথ উদ্যোগ, সম-অংশীদারিত্বের এক নতুন যুগের সূচনা করেছে, যেখানে ভারত আর নিছক অংশগ্রহণেই থেমে নেই, সে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হচ্ছে।গোটা মিশন জুড়েই ইসরোর ফ্লাইট সার্জেনরা শুক্লার স্বাস্থ্যের উপর নজর রেখেছিলেন, তাঁর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সুনিশ্চিত করেছিলেন। শুক্লা চনমনে ছিলেন, তিনি সারা ভারতের পড়ুয়াদের সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নেন। লক্ষ্ণৌ থেকে ত্রিবান্দ্রম, ব্যাঙ্গালোর থেকে শিলং – বিজ্ঞান ও মহাকাশের সম্ভাবনা প্রতিটি তরুণ মনে রেখাপাত করেছে। শুক্লা নিরাপদে ফিরে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বিপুল তথ্য, নমুনা এবং এমন এক অন্তর্দৃষ্টি, যা ভারতের আগামী গগনযান মিশন এবং ভারত মহাকাশ কেন্দ্র স্থাপনে সহায়ক হবে। এ কেবল একজন মহাকাশচারীর কথা নয়, এ একটা গোটা জাতির জেগে ওঠার কাহিনী। এ হলো মহাকাশ বিজ্ঞানকে জনসেবায় কাজে লাগানোর উদ্যোগ। মহাশূন্যে যে গবেষণা চালানো হয়েছে, তার সুফল ভারতের প্রতিটি কোণে পৌঁছে যাবে, প্রত্যন্ত গ্রামে উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শহরের হাসপাতালগুলিতে ব্যাধিমুক্তির ওধুষপত্র পর্যন্ত।আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথায়, গগনযান হল ভারতীয় মাধ্যমে একজন ভারতীয়কে মহাকাশে পাঠানো। অ্যাক্সিয়ম-৪ হল এর মহড়া, এই ধারণার বাস্তব প্রমাণ, আকাঙ্খা ও সাফল্যের সেতুবন্ধন।আজ আমরা যখন তারার দিকে তাকাই, তখন তাতে নিছক বিস্ময় থাকেনা, মিশে থাকে কোনো উদ্দেশ্য। কারণ ভারতের ক্ষেত্রে আকাশ আজ আর কোনো সীমা নয়, এ এক পরীক্ষাগার। লেখক- ডঃ জিতেন্দ্র সিং, স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ভূবিজ্ঞান ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, পারমাণবিক শক্তি দপ্তর, মহাকাশ দপ্তর, কর্মীবর্গ, জন-অভিযোগ ও পেনশন দপ্তর ।