বেবি চক্রবর্ত্তী
সূর্যঘড়ি থেকে স্মার্ট ওয়াচের অভিযাত্রা১৪ শতকে প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরি হয়েছিল। পেন্ডুলাম ঘড়ি ১৬৫৬ সালে ক্রিস্টিয়ান হাইজেনস প্রথম পেন্ডুলাম ঘড়ি আবিষ্কার করেন। এই ঘড়ির আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৬৫৬ সালে পেন্ডুলাম চালিত প্রথম কার্যকর ঘড়ি আবিষ্কার করেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন। ডানে-বাঁয়ে হেলে-দুলে বেশ ভালোভাবেই ঘুরিয়ে দিত মিনিট ও ঘণ্টার খাঁজকাটা চাকতিগুলো। পরে ১৯০৬ সালে পেন্ডুলাম ক্লকের পিছনে প্রথমবারের মতো জুড়ে দেওয়া হয় ব্যাটারি!ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসার বলেছিলেন “সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। কিন্তু মানুষ চিরকাল চেয়েছে সময়কে ধরতে। নিয়ন্ত্রণ করতে। সেই চেষ্টারই এক আশ্চর্য রূপ হলো ঘড়ি। আগুন, জল, বালি থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটাল স্মার্টওয়াচ – সময় গণনার এই যন্ত্রের পথচলা এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস।প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে সময় পরিমাপ করা হতো সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থান দেখে।সূর্যঘড়ি প্রাচীন মিশর ও গ্রিসে ব্যবহৃত হতো। একটি লাঠির ছায়া দেখে বোঝা যেত দিনের কোন সময় চলছে। জলঘড়ি মিশর ও চীন সভ্যতায় ব্যবহৃত হত। একটি পাত্র থেকে ধীরে ধীরে পানি পড়ার মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করা হতো। বালিঘড়ি মধ্যযুগে জনপ্রিয় হয়। দুইটি কাঁচের বাল্বের মধ্যে বালি পড়ে সময় বোঝানো হতো। ১৩শ শতকে ইউরোপে প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ির উদ্ভব ঘটে। গিয়ারচালিত ঘড়ি। ১৩০০ সালের দিকে ইউরোপের গির্জায় বড় ঘড়ি বসানো শুরু হয়। ঘন্টার ঘণ্টাধ্বনি বাজানোই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। ১৪৫০ সালে প্রথম হাতঘড়ি আবিষ্কার হয়। যা কোমরে ঝোলানো হতো। ১৬শ শতকে পকেট ঘড়ি জনপ্রিয় হয় ইউরোপীয় অভিজাতদের মধ্যে। ১৮৬৮ সালে সুইস কোম্পানি পাটেক ফিলিপ তৈরি করে প্রথম মহিলা “হাতঘড়ি”। এরপর ১৯০৪ সালে লুইস কারটিয়ের তাঁর বন্ধুর জন্য তৈরি করেন প্রথম পুরুষদের হাতে পরার উপযোগী ঘড়ি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাদের সময় বোঝার জন্য হাতঘড়ির ব্যবহার ব্যাপক হারে শুরু হয়।১৯৬৯ সালে সেইক কোম্পানির কোয়ার্টজ প্রযুক্তি সময় নির্ধারণে বিপ্লব আনে। ব্যাটারিচালিত এই ঘড়ি অনেক সস্তা ও নির্ভুল।ডিজিটাল ঘড়ি এল এল.ই.ডি ও এল.সি.ডি স্ক্রিন যুক্ত ঘড়ি ১৯৭০-এর দশকে জনপ্রিয় হয়।ভারতে ব্রিটিশ আমলেই আধুনিক ঘড়ির প্রচলন শুরু হয়। রেলওয়ের সময়সূচী, ডাকব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাজে সময় নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া স্টেশন, বা মুম্বইয়ের বিক্টোরিয়া টার্মিনাসে যে বিশাল ঘড়িগুলি দেখা যায়, তা সেই ঐতিহ্যেরই নিদর্শন।অন্যদিকে, বেনারস বা কলকাতার ঘড়িওয়ালা পরিবারগুলি প্রজন্ম ধরে ঘড়ি মেরামতের কাজে যুক্ত রয়েছেন।ঘড়ি শুধু সময় বলে না, এটি সময়কে ধারণ করে—মানুষের সভ্যতার, প্রযুক্তির, চাহিদার এবং রুচির বিবর্তনের ইতিহাসও বটে। বালির মতোই সময় গলে যায়, কিন্তু ঘড়ি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সময়কে যত্ন করে ব্যবহার করাটাই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তা। এই সময় আরেক জার্মান গবেষক জোস্ট বার্জিও তৈরি করেন আরেকটি যান্ত্রিক ঘড়ি যেখানে মিনিটের কাঁটা ছাড়া আর কোনো নির্দেশক ছিল না তাতে।এখানে ঘড়ির ইংরেজি নাম ক্লকের পেছনেও রয়েছে অবদান পেণ্ডুলাম ঘড়ির। আজ থেকে প্রায় সাতশো বছর আগে লাতিন শব্দ ‘ক্লক্কা’ বা ঘণ্টি থেকে উদ্ভব হয় ইংরেজি ক্লক শব্দটির। এদিকে আধুনিক কোয়ার্টজ ঘড়ির জন্ম হয় বিংশ শতকে। বিদ্যুৎ কিংবা চাপ প্রয়োগে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে কাঁপতে পারে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল ধাতু। এ ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ১৯২০ সালে আসে প্রথম কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল ঘড়ি। সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ সময়ের হাত ধরে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু যুগ কালে কালে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে সময় দেখার যন্ত্র তথা ঘড়ি। একটা সময় ছিল। যখন সূর্যের অবস্থান দেখেই মানুষ ধারণা লাভ করত সময় সম্পর্কে। এমনকি মানুষের তৈরি প্রথম যান্ত্রিক ঘড়িতেও কাজে লাগানো হয়েছিল সূর্যের সময় ভিত্তিক অবস্থানের এই সূত্রকেই।আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মিসর ও ব্যাবিলনে উৎপত্তি হয় প্রথম সূর্যঘড়ির। গোলাকার চাকতিতে একটি নির্দেশক কাঁটা ও দাগ কাটা সময়ের ঘর এ নিয়েই সূর্যঘড়ি।খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকে মিশরে উৎপত্তি হয় পানিঘড়ির। বালিঘড়ির মতো করে কাজ করা এই ঘড়িটির নাম রাখা হয় ক্লেপসাড্রা। একটি বড় পাত্র থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় একটি ছোট পাত্রে পানি পড়ার মাধ্যমেই এগিয়ে চলে সময়ের কাঁটা। নিচের ছোট পাত্রের সঙ্গে জুড়ে থাকে একটি খাঁজযুক্ত দণ্ড। ওটাই একটু একটু করে ঘোরাতে থাকে সময়ের গিয়ার।পানিঘড়ির হাত ধরেই আসে দিন, মাস ও ঘণ্টার ধারণা। এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো। গ্রিকরাই প্রথম বছরকে ১২ ভাগে ভাগ করে। এরপর উপবৃত্তাকার কক্ষপথকে ৩৬০ ডিগ্রি ধরে তাকে ১২ দিয়ে ভাগ করেই পাওয়া গেল মাসের ৩০ দিন।মিসরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা সূর্যের উদয়-অস্ত নিয়ে দিনকে দুটো সমান ভাগে ভাগ করল। এভাবে এলো ১২+১২ = ২৪ ঘণ্টা। সে সময় তাদের সংখ্যা গণনার ভিত্তি ছিল সেক্সাজেসিমাল তথা ৬০। আর এ কারণেই ঘণ্টা ও মিনিট ভাগ হলো সমান ৬০টি ভাগে। জার্মানির পিটার হেনলেইন ১৫১০ সালে প্রথম স্প্রিং চালিত ঘড়ি আবিষ্কার করেন। তবে ওটা নিখুঁত সময় দিতে পারত না।এরই ধারাবাহিকতায় আসতে থাকে একের পর এক আধুনিক ও দামি সব ঘড়ি। কোয়ার্টজ ঘড়ি হল এক ধরনের ঘড়ি যা সময় দেখানোর জন্য কোয়ার্টজ। স্ফটিকের কম্পন ব্যবহার করে। এই ঘড়িগুলি ব্যাটারি বা সৌর কোষ দ্বারা চালিত হয়। সাধারণত যান্ত্রিক ঘড়ির চেয়ে বেশি নির্ভুল হয়। একটি কোয়ার্টজ ঘড়ির মূল অংশ হল একটি কোয়ার্টজ স্ফটিক। যখন এই স্ফটিকের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। তখন এটি একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্পিত হতে থাকে। এই কম্পনগুলি একটি মাইক্রোচিপ দ্বারা সংকেতে রূপান্তরিত হয়। যা ঘড়ির হাতকে ঘুরিয়ে সময় নির্দেশ করে। কোয়ার্টজ ঘড়িগুলি সাধারণত খুব নির্ভুল হয় এবং সময় রক্ষণাবেক্ষণে ভালো। এগুলি দীর্ঘ সময় ধরে চলে এবং কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। কোয়ার্টজ ঘড়িগুলি সাধারণত যান্ত্রিক ঘড়ির চেয়ে কম দামে পাওয়া যায়।এগুলি ব্যবহার করা সহজ এবং প্রায়শই ব্যাটারি প্রতিস্থাপন ছাড়া অন্য কোনও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় না। কোয়ার্টজ ঘড়ি হল একটি আধুনিক। নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী ঘড়ি যা সময় জানানোর জন্য কোয়ার্টজ স্ফটিকের কম্পন ব্যবহার করে।পেন্ডুলাম ঘড়ি হল এক ধরনের ঘড়ি। যা সময় মাপার জন্য পেন্ডুলাম ব্যবহার করে। পেন্ডুলাম হল একটি ওজন যা একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে ঝোলানো থাকে এবং মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে সামনে পিছনে দুলতে থাকে। এই দোলনের নিয়মিত সময়কাল ঘড়ির সময় গণনার ভিত্তি তৈরি করে। পেন্ডুলাম ঘড়ির মূল কাজ হল সময় পরিমাপ করা। একটি নির্দিষ্ট গতিতে হয়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে ঝোলানো থাকে এবং মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে দুলতে থাকে। প্রতিটি সম্পূর্ণ দোলনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে। এটি ঘড়ির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে।পেন্ডুলামের দোলন নিয়মিত এবং স্থিতিশীল হয়।ঘড়িটিকে সঠিক সময় বজায় রাখতে সাহায্য করে। পেন্ডুলাম ঘড়ি সাধারণত ক্লাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী নকশার হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রকার পেন্ডুলাম ঘড়ি বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায়, যেমন দেয়াল ঘড়ি, টেবিল ঘড়ি, এবং দাদু ঘড়ি। পেন্ডুলাম ঘড়ি সাধারণত ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি একটি আকর্ষণীয় অলঙ্কারও বটে। পেন্ডুলাম যত লম্বা হবে, ঘড়ির গতি তত ধীর হবে।এই ঘড়ি প্রথম দিকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এটি ঘড়ি তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ছিল।ঘড়ির ইতিহাস শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩৫০০ বছর আগে প্রাচীন মিশরে। তাঁরা সূর্যের অবস্থান দেখে সময় মাপার জন্য তৈরি করেছিল সূর্যঘড়ি। একটি দণ্ডকে মাটিতে গেঁথে, তার ছায়া কোথায় পড়ছে তা দেখে সময় নির্ণয় করা হতো। তবে এটি ছিল শুধুমাত্র দিনের বেলায় কার্যকর।সূর্যঘড়ির সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে মানুষ তৈরি করল জলের ঘড়ি। প্রাচীন চীন ও গ্রিসে ব্যবহৃত এই যন্ত্রে নির্দিষ্ট হারে জল পড়ে একটি পাত্রে। সেই গতিকে সময়ের মান হিসেবে ধরা হতো। অন্যদিকে বালিঘড়ি ছিল আরেক জনপ্রিয় আবিষ্কার—দুইটি কাচের পাত্রের মাঝে নির্দিষ্ট হারে বালু পড়ে সময় নির্দেশ করতে। ১৩শ শতাব্দীতে ইউরোপে আসে যান্ত্রিক ঘড়ি । এটি ছিল প্রথমবারের মতো চাকা, দণ্ড এবং স্প্রিং-এর মাধ্যমে সময় মাপার উপায়। ১৩৮৬ সালে ইংল্যান্ডের স্যালিসবেরি ক্যাথেড্রালে স্থাপিত একটি যান্ত্রিক ঘড়ি এখনও সচল রয়েছে। সময়ের সাথে ঘড়ির মুখে মিনিট ও সেকেন্ড যুক্ত হয়।১৬৫৬ সালে বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স পেন্ডুলাম ব্যবহার করে এমন ঘড়ি তৈরি করেন, যা ছিল আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল। এ ঘড়ির ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে দেয়ালঘড়ি ও বড় বড় টাওয়ার ঘড়ি তৈরি হয়।১৮৬৮ সালে প্রথম আধুনিক হাতঘড়ি তৈরি হয়। তবে প্রথমদিকে এটি ছিল নারীদের অলংকারস্বরূপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরুষ সেনারা ব্যবহারে উৎসাহী হলে এটি জনপ্রিয়তা পায়।১৯৫৭ সালে এল ইলেকট্রিক ঘড়ি, তারপর আসে কোয়ার্টজ ঘড়ি যার সময় গণনা অনেক বেশি নিখুঁত।

১৯৭০-এর দশকে আসে ডিজিটাল ঘড়ি, যার মাধ্যমে সময় দেখা যেত এলইডি বা এলসিডি স্ক্রিনে। এরপর আসে প্রযুক্তির চূড়ান্ত রূপ — স্মার্টওয়াচ। এখন ঘড়ি শুধু সময় নয়, হৃদস্পন্দন, বার্তা, ইন্টারনেট, এমনকি ফোন কলও নিয়ন্ত্রণ করছে। অ্যাপল, স্যামসাং, গারমিন, শাওমি-সহ বহু সংস্থার স্মার্টওয়াচ বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। সময়ের সাথে ঘড়ির পথচলা ঘড়ি আজ শুধু সময় দেখায় না। এটি হয়ে উঠেছে স্টাইল স্টেটমেন্ট, স্বাস্থ্য নজরদারি, এমনকি ডিজিটাল সচেতনতার অংশ। ঘড়ির বিবর্তন আসলে আমাদের সভ্যতা, প্রযুক্তি ও চাহিদার বিবর্তনের এক আয়না।ঘড়ির এই দীর্ঘ বিবর্তনের পথে সূর্য ও ছায়া থেকে শুরু করে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবলম্বিত স্মার্টঘড়ি—প্রমাণ করে সময়কে ধরার আকাঙ্ক্ষা মানবজাতির এক চিরন্তন প্রয়াস। সময়ের এই অনন্য যন্ত্র মানুষকে শুধু সময় ছাড়াও ইতিহাসের গতিপথে চালকের ভূমিকা পালন করেছে।