ছাব্বিশে তৃণমূলের বিসর্জন, হুঙ্কার শমীকের
সপ্তর্ষি সিংহ
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আর একবছরও বাকি নেই। তার আগে রাজ্য বিজেপির সভাপতি পদে বসলেন শমীক ভট্টাচার্য। বঙ্গ বিজেপির ব্যাটন শমীকের হাতে যাওয়ায় তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার নতুন মোড় নিল বলে মত রাজনৈতিক মহলের। তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জও অনেক। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কিভাবে শমীক ভট্টাচার্য সংগঠনকে চাঙ্গা করেন, সেদিকেই তাকিয়ে বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। বৃহস্পতিবারই সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে শমীককে সংবর্ধনা দেওয়া দলের পক্ষ থেকে। আর সেই অনুষ্ঠান থেকেই তৃণমূলে উৎখাত করার ডাক দিয়েছেন বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি। তাঁর হুঙ্কার, ‘তৃণমূলের পতন অনিবার্য। ছাব্বিশের নির্বাচন, তৃণমূলের বিসর্জন’। শমীকের জন্ম ১৯৬৩ সালের ৫ নভেম্বর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে স্নাতক পাশ করেন তিনি। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শমীক। প্রথম জনসংঘের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সাল থেকেই আরএসএসে মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৯৭৪ সাল নাগাদ হাওড়ার মন্দিরতলা এলাকায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক (আরএসএস)-এর শাখায় যাতায়াত শুরু হয় শমীকের। সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য পরিচয় নিয়েই রাজনীতিতে যোগ দেন। শমীক সেই জমানার লোক। বিজেপিতে তখন হাতে গোনা কয়েকজন নেতানেত্রী। শমীক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সুবক্তা হিসেবেই তিনি সুপরিচিত। ভরপুর বাম জমানায় কমরেডরা খোঁচা দিয়ে বলতেন, ‘বিধানসভায় যাদের প্রতিনিধিত্ব নেই, তাদের আমরা সর্বদলীয় বৈঠকে ডাকি না।’ সেই সময় মুরলীধর সেন লেনের পার্টি অফিসে রাহুল সিনহা, তথাগত রায়ের সঙ্গী ছিলেন শমীক। তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলেন, দলবিরোধী প্রতিক্রিয়া জানাতে কখনও শোনা যায়নি তাঁকে। তাই দলছুট হননি তিনি। তবে বিজেপির অন্দরে ‘ঘরের লোক’ বলে পরিচিত হলেও শমীক কেন দলে গুরুত্ব পাননি, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
একটি অংশের দাবি, শমীকের কার্যত ‘একক শক্তি’তে জয় দলের অন্দরে আলোড়ন তৈরি করেছিল। ফলে তখন পদাধিকারীদের অনেকে ‘আশঙ্কিত’ হয়ে পড়েছিলেন। শমীকের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, দলের অন্দরে যা-ই হোক, শমীক বরাবর নিষ্ঠার সঙ্গে দলের কাজ করে এসেছেন। দলের কারও বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।
২০০৬ সালে প্রথম বিজেপির টিকিটে শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে লড়ে হেরে যান। এরপর ২০১৪ সালে বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে উপনির্বাচনে জিতে বিধানসভায় যান। তবে ২০১৬ সালে ওই কেন্দ্র থেকেই ভোটে হেরেও যান। তথাগত রায় সভাপতি থাকার সময় থেকেই শমীকের উত্থান শুরু। তখনই তিনি রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৯ সালে দমদম লোকসভা কেন্দ্রে সৌগত রায়ের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। কিন্তু জিততে পারেননি। ২০২১ সালে রাজারহাট-গোপালপুর কেন্দ্র থেকেও হারতে হয়। ২০২০ সালে তাঁকে রাজ্য মুখপাত্র করে দল। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে বঙ্গ বিজেপির প্রথম রাজ্য সভাপতি প্রাপ্তি থেকে আজকের সুকান্ত মজুমদার, পূর্বতন সব রাজ্য সভাপতি হওয়ার সাক্ষী শমীক ভট্টাচার্য। আগে গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন হরিপদ ভারতী, বিষ্ণু কান্ত শাস্ত্রী, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তপন শিকদার, অসীম ঘোষ, তথাগত রায়, সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়, রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষের মতো তাবড় তাবড় পদ্ম নেতারা। সেই শমীক যেমন রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে ঝড় তোলেন। তেমন টিভি ডিবেটেও তাঁর বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে রাখে দর্শককে। অনেকে আড়ালে আবডালে বলেন, শমীক দাঁড়ালে নাকি টিআরপি বাড়ে। রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর শমীকের বক্তব্য, ‘পরাজয় নিশ্চিত জেনে, জামানত বাজেয়াপ্ত হবে জেনেও যাঁরা ঘাম রক্ত ঝরিয়েছিলেন, তাঁরা থাকবেন। তাঁরা না থাকলে দল এ জায়গায় আসত না। আর যাঁরা নতুন এসেছেন, অত্যন্ত সক্রিয় ভাবে বিজেপি করছেন, তাঁরাও থাকবেন। পুরোনোদেরও বুঝতে হবে, সংগঠনে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক নিতে হয়। কুমোরটুলি থেকে অর্ডার দিয়ে লোক আনা যায় না। ফলে নতুন ও পুরোনোর কোনও বিতর্ক থাকবে না।’ স্মৃতিশক্তিও তুখোড় বিজেপির এই নেতার। এক সময় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সংস্পর্শেও এসেছেন। বাড়িতে আজও বইয়ের পাহাড়। তিনি পড়তে ভালোবাসেন। লেখালেখিও করেন। সেই শমীক ভট্টাচার্যের হাতেই রাজ্য বিজেপিকে চালনা করার দায়িত্ব।সেই দায়িত্ব পালনে শমীক ভট্টাচার্য কতটা সফল হন, তা সময়ই বলবে।