চিরকালের দুঃসহ স্মৃতি
নয়াদিল্লী: ৫০ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ভারত সাক্ষী থাকল তার অন্ধকারতম গণতান্ত্রিক মুহূর্তে যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন, যা দেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় অনপনেয় দাগ রেখে গেল। এর পরের ২১ মাসে যা ঘটল তা ভারতীয়দের মনে গণতন্ত্র, সরকার এবং সাংবিধানিক ঐতিহ্যের ধারণাগুলির আমূল পরিবর্তন ঘটালো। সেই দুর্ভাগ্যের সকালে এমনই এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল যখন গণতন্ত্রের জননী ক্ষমতালোভী শাসকের কাজে লজ্জায় পড়লেন। এলাহাবাদ হাইকোর্ট মারাত্মক রায় দিয়েছিল ১৯৭১-এর লোকসভা নির্বাচনে নিবাচনী অনিয়মের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং সরকারি পদে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে। পদত্যাগ করার জন্য ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন যা সারা দেশকে চমকে দিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সম্মতি ছাড়াই সরকারি লেটারহেডের পরিবর্তে সাদা কাগজে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের কাছে “অভ্যন্তরীণ অশান্ত পরিস্থিতি”-র নজির দেখিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে সংবিধানের ৩৫২ ধারা প্রয়োগের সুপারিশ করলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে পাশ কাটানোয় সুপ্রতিষ্ঠিত সংবিধান চালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর ওই পদক্ষেপ ছিল এক প্রবল আঘাত। পরের দিন সকালে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে ২৬ জুন সকাল ৬টায় অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এই পদক্ষেপ প্রকৃত অর্থে স্বৈরতন্ত্রের সূচনা করল। রাতারাতি উধাও হয়ে গেল নাগরিকদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা। কলমের এক আঁচড়ে সংবিধান প্রদত্ত ১৯ ধারার বাক স্বাধীনতা, জমায়েত হওয়া এবং আন্দোলনের স্বাধীনতা স্থগিত হয়ে গেল। ২১ ধারায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষা হয়ে গেল শূন্য এবং সবচেয়ে যা খারাপ নাগরিকরা ৩২ ধারায় আদালতে যাওয়ার সুযোগ হারালেন, যাকে বাবা সাহেব বি আর আম্বেদকর বলেছিলেন, সংবিধানের “হৃদয় এবং আত্মা”। জরুরি অবস্থার প্রথম শিকার হয়েছিলেন বিরোধী নেতারা যাঁরা সাহসের সঙ্গে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। মেন্টেন্যান্স অফ ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট “মিসা” এবং ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া “ডিআইআর” আইনে হাজার হাজার মানুষের কারাদণ্ড হল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রত্যেক নাগরিককেই ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের এই অন্ধকার দমনমূলক অধ্যায়ের ক্ষত বহন করতে হয়েছিল।এই যুগ সাক্ষী ছিল দেশের কার্যনির্বাহী, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের ওপর অভূতপূর্ব আঘাতের। জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধী গৃহীত স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ দেশের মানুষের স্মৃতিতে এখনও জাগরূক। আমার ৯২ বছর বয়সী ঠাকুরদাদা ব্যস্ত ছিলেন তাঁর দৈনন্দিন গরু পালনের কাজে, আচমকাই তাঁর আঙুল কেটে যায় এবং তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিকানিরের পিবিএম হাসপাতালে। ভর্তি হওয়ার পর তিনি দেখলেন, কর্মরত চিকিৎসকরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলে নির্বীজকরণে লক্ষ্যপূরণের চাপে রয়েছে, সঞ্জয় গান্ধীর প্রচণ্ড প্রভাবে, কূটপরিকল্পনা হচ্ছিল তাঁকে জোর করে নির্বীজকরণে। এই অমানবিক এবং জোরজার করার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আমার ঠাকুরদাদা তৎক্ষণাৎ হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যান, আঘাতের চিকিৎসা না করিয়েই। যে হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার কথা, সেটাই পাল্টে হয়েছে মারাত্মক অভিজ্ঞতা লাভের কেন্দ্র। তিনি কোনওরকমে পালালেন বটে, কিন্তু গোটা সম্প্রদায়ের ওপর এই মানসিক উদ্বেগ গভীর ছাপ ফেলে গেল। তিনি পার পেলেও দুঃখজনকভাবে ১ কোটির বেশি মানুষকে জোর করে ১৯৭৫-৭৭-এর মধ্যে নির্বীজকরণ করা হয়েছিল যা রচিত করে ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের এক অন্ধকারতম অধ্যায়।এই সময়ে একটিমাত্র পরিবারের স্বার্থ রক্ষা করতে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের যথেচ্ছ অপব্যবহার স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৭৬-এর ২৪ মার্চ একটি যুব সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য বিকানীরে সঞ্জয় গান্ধীর সফরকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়েছিল। কোনও সাংবিধানিক পদে না থাকা সত্ত্বেও এবং রাজ্য সরকারের অতিথি না হয়েও তাঁর সফরে পূর্ণ মাত্রায় সরকারি সম্পদের ব্যবহার করা হয়। প্রোটোকল লঙ্ঘন এবং জনসাধারণের অর্থের অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই সময় ডাক ও তার বিভাগে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করার সময় আশ্চর্যজনকভাবে আমি দেখলাম যে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হল সমাবেশে মঞ্চের নীচে সাময়িকভাবে সরাসরি টেলিফোন সংযোগ দেওয়ার যে ব্যবস্থা সাধারণত করা হয়, কোনও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি সফরের সময়। এর থেকেই বোঝা যায় সঞ্জয় গান্ধী কীভাবে অন্যায্য প্রভাব খাটাতেন। এর থেকে এটাও প্রমাণ হয় সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে জোর করে সাংবিধানিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করেও কীভাবে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উচ্চাশার সেবা কাজে লাগানো যায়য়।এমন একটা সময় ছিল যখন সাধারণ মানুষ তাঁদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, সেই সময় এইরকম ঝলমলে প্রদর্শনী, তাও আবার জনগণের টাকায় প্রমাণ করে সাংবিধানিক পবিত্রতাকে সরাসরি অসম্মান। এই ধরনের ঘটনা নৈতিক অবক্ষয় এবং স্বৈরতান্ত্রিক একগুঁয়েমিকে তুলে ধরে। যাকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে বেশি দুর্যোগপূর্ণ গণতান্ত্রিক সঙ্কট। জরুরি অবস্থার সময় সংবিধান সংশোধনের রীতিনীতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই মারাত্মক খাটো করে। বৈষম্য সৃষ্টি করে, দেশের স্তম্ভগুলির মধ্যে। ৩৮-তম সংবিধান সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্তটিকে আদালতের আওতা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় এবং অধ্যাদেশ পাশ করাতে রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৫-এর দশই অগাস্ট ৩৯-তম সংবিধান সংশোধনীটি আইনে পরিণত হওয়ার পরে পরেই প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং লোকসভা অধ্যক্ষের মতো সাংবিধানিক উচ্চপদগুলির সঙ্গে জড়িত নির্বাচন সংক্রান্ত বিতর্কের বিচার করার ভার পূর্বাপরভাবে আদালতের আওতার বাইরে চলে যায়। এটা পরিষ্কার, এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রতিকূল রায়ের পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বিচারের হাত থেকে বাঁচাতেই এই প্রচেষ্টা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কমে গেল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কুখ্যাত এডিএম জব্বলপুর বনাম শিবকান্ত শুক্লা মামলায়। যেখানে সুপ্রিম কোর্ট জরুরি অবস্থার সময় মৌলিক অধিকার প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তকে বহাল রেখেছিল। একমাত্র বিরুদ্ধ স্বর, বিচারপতি এইচআর খান্না যিনি সাহসের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন, তাঁকে সবচেয়ে বর্ষীয়ান বিচারপতি হওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সময় তাঁকে পাশ কাটিয়ে অন্যকে করা হয়। যা বিচাব বিভাগীয় নিষ্ঠার প্রতি সরাসরি আঘাত। স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ৪২-তম সংবিধান সংশোধনীটি পাশ করা হয়। লোকসভার মেয়াদ ৫ থেকে ৬ বছর করার জন্য, ফলে গণতান্ত্রিক মতামতের কোনও দাম থাকলো না। নতুন করে নির্বাচন ছাড়াই আইনসভার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া হল। একইসঙ্গে প্রস্তাবনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হল। তিনটি নতুন শব্দ সোশালিস্ট, সেকিউলার এবং ইন্টিগ্রিটি যুক্ত করে। জরুরি অবস্থার সময় সরকার সংসদে কোনও রকম বিতর্ক, যাচাই এবং সংশোধনী ছাড়াই সাধারণ আইনি প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে ৪৮টি অধ্যাদেশ পাশ করায়। জরুরি অবস্থার পর গঠিত শাহ কমিশন ওই কালো মাসগুলির সময়ে পাইকারি হারে আটক, দরিদ্রদের বাধ্যতামূলক নির্বীজকরণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের নিদারুণ ছবি তুলে ধরেছিল। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল এই স্বৈরতান্ত্রিক আমলে। বিরোধী নেতাদের প্রতি সমব্যাথী সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধীর নিজের স্থাপিত নামী নবজীবন প্রেসের যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করা হয়। অর্থাৎ এটা স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর এক প্রতীকি হামলা। অভূতপূর্বভাবে চারটি বড় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া, ইউনাইটেড নিউজ অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান সমাচার এবং সমাচার ভারতীকে মিশিয়ে একটিমাত্র সংস্থা সমাচার করে দেওয়া হয়। জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পরে কংগ্রেসের দ্বিচারিতা প্রকাশিত হয়ে গেছে। একদিকে ‘সংবিধান বাঁচাও যাত্রা’-র নামে ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযান চালাচ্ছে, অন্যদিকে পূর্বসূরীরা যেভাবে সংবিধানকে হাস্যকর করে তুলেছিলেন সেই বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্চ্য করা হচ্ছে না। ১৯৮৫-র ২৩ জুলাই শ্রী রাজীব গান্ধী এই ভীষণ অধ্যায়ের জন্য গর্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন “জরুরি অবস্থায় কোনও ভুল নেই।” এই ধরনের স্বৈরতন্ত্রী কাজে গর্বিত হওয়া বোঝায় পরিবার এবং ক্ষমতা, এটাই কংগ্রেসের অগ্রাধিকারের তালিকায় থেকে গেছে।আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন ছিলেন ২৫ বছর বয়সী। সাহসিকতার সঙ্গে এই স্বৈরতান্ত্রিক আমলে বিরোধিতা করেছিলেন অভিনব উপায়ে। ধরা পড়া এড়াতে তিনি বিভিন্ন ছদ্মবেশে সাজতেন, গুপ্ত সভার আয়োজন করতেন এবং জরুরি অবস্থা বিরোধী পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতেন। যখন আরএসএস আত্মগোপন করতে বাধ্য হয় তখন মোদীজি নবগঠিত গুজরাট লোক সংঘর্ষ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কংগ্রেস সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পথে বিরোধিতা চালিয়ে গেছেন নিরলসভাবে।অতীতের ক্ষতের কথা মনে রেখে মোদী সরকার ২০২৪-এর ১১ জুলাই গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ২৫ জুনকে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিনটির উদযাপন মনে করিয়ে দেয় জরুরি অবস্থার সময়ে সাংবিধানিক আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার কথা। দেশবাসীকে আহ্বান জানায় গণতন্ত্রের সতর্ক অভিভাবক হওয়ার জন্য এবং ইতিহাসের ওই কালো অধ্যায়গুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেক কষ্টে প্রাপ্ত স্বাধীনতার মূল্য বোঝাতে। জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পরে এটা আমাদের সব সময় মনে করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্রের দাবি, নিরবচ্ছিন্ন সতর্কতা। আমাদের সংবিধান বহু প্রজন্মের আত্মত্যাগ, প্রজ্ঞা, আশা এবং প্রত্যাশার প্রতিরূপ। প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে যেখানে ভারত ২০৪৭-এ বিকশিত ভারত হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে, তখন আমাদের এর পবিত্রতা রক্ষা করতে আমাদের দায়বদ্ধতা পুনরায় ব্যক্ত করতে হবে, মানুষের সংকল্প থেকে শক্তি নিয়ে একটি প্রাণবন্ত এবং উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ গঠনে।
(লেখক- অর্জুন রাম মেঘওয়াল, ভারত সরকারের আইন ও বিচার মন্ত্রকের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী)