তুষার পাটোয়ারী
প্রতীক্ষার অবসান। গত ক’দিন ধরে হয়েছে সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় রীতি মেনে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান। বুধবার দুপুর ৩টে ১১ মিনিটে শুভ লগ্নে এই ঐতিহাসিক মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত করেন তিনি। তার আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিবেশনায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে সমগ্র দিঘা। বাংলার চলচ্চিত্র ও সংগীত জগতের তারকারা মিলে এক অপূর্ব ‘সময়’-এর সৃষ্টি করেন। কলসযাত্রার পর মঙ্গলবার মহাযজ্ঞ করা হয়। এদিন জগন্নাথ মন্দির দ্বারোদ্ঘাটনের শুভক্ষণে দিঘায় চাঁদের হাট। অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দেখা যায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। দেব, জুন মালিয়া, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, লাভলি মৈত্র, জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচি, শ্রীকান্ত মোহতা, অরিন্দম শীল, নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন দিঘায়। জগন্নাথদেবের টানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন টেলিপর্দার তারকারাও। দেখা যায় দেবলীনা কুমার, ভিভান ঘোষকেও। অনুষ্ঠান পর্ব শেষের পরই এদিন কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জানান, এই জগন্নাথধাম রাজ্যের নতুন তীর্থ কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তিনি ঘোষণা করেন, মন্দিরের প্রসাদ ও ছবি প্রতিটি গৃহে পৌঁছে দেওয়া হবে। শুধু রাজ্যেই নয়, সারা দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের কাছেও তা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই দায়িত্ব থাকবে রাজ্য সরকারের আইএনসি (ইনফর্মেশন অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্স) বিভাগের উপর।বুধবার বিকেল থেকেই জগন্নাথ মন্দিরের দ্বার সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। দিঘার এই নতুন তীর্থক্ষেত্র আগামী দিনে রাজ্যের পর্যটন ও ধর্মীয় ভাবনার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠবে বলেই মনে করছেন সকলে। দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্দিরে ঢোকার আগে দিলেন সম্প্রীতির বার্তা। জানালেন, বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাবে জগন্নাথদেবের প্রসাদ ও ছবি। মমতা এদিন বলেন, “সব ধর্মের লোক এসেছে। স্থানীয়দের সাহায্য পেয়েছি, সেলেব-শিল্পপতি সবাইকে ধন্যবাদ। সনাতন ব্রাহ্মণ ধর্ম, আদ্যাপীঠের মহারাজ, স্বামীজির বাড়ি, বেলুড় মঠ, জয়রামবাটি, কামারপুকুর, কালীঘাট, ইসকন, পুরীর দ্বৈতপতি সবাই এসেছেন। সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষ এসেছেন। তিন বছর ধরে কাজ শেষ হয়েছে। হিডকোর সকলকে অভিনন্দন। যাঁরা এই কাজ করেছেন সকলকে ধন্যবাদ। মন্দির চত্বরকে কেন্দ্র করে ৫০০-র বেশি গাছ বসানো হয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে তীর্থস্থান হিসেবে পর্যটক তরঙ্গে উন্মদনার প্লাবন তৈরি করবে এই মন্দির। সবাই আসুন। সবারে করি আহ্বান।” মমতা আরও বলেন, “সকলেই ভোগ পাবেন। গজা, প্যারা, খাজার দোকান হচ্ছে। মন্দিরের ছবি, প্রসাদ সারা বাংলায় পৌঁছে দেওয়া হবে। গোটা দেশে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। ইসকন ভোগের ব্যবস্থা করবে রোজ।” সারা বিশ্বে শান্তিকামনা করে জগন্নাথ মন্দিরে ঢোকেন মুখ্যমন্ত্রী। বহু প্রতীক্ষিত অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে জগন্নাথদেবের প্রাণপ্রতিষ্ঠার উৎসব শুরু হল। তার প্রাক্কালেই মঙ্গলবার পূর্বসূচী অনুযায়ী মহাযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে, উড়েছে ধ্বজাও। নীল জলরাশি আর আকাশের সন্ধিস্থলে এ যেন একটুকরো স্বর্গ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন টলিপাড়ার একঝাঁক তারকা। জগন্নাথধামের উদ্বোধন উপলক্ষে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন নচিকেতা চক্রবর্তী, অদিতি মুন্সি-সহ আরও অনেকে। দেবের মন্তব্য, ‘‘সম্প্রীতির ঐতিহাসিক মিলনক্ষেত্র দিঘায় জগন্নাথধামকে সাক্ষী রেখে মুখ্যমন্ত্রী গোটা দেশকে বার্তা দিয়েছেন। আসলে দিঘায় এখন পর্যটনের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মিলন ঘটেছে বঙ্গোপসাগরের সৈকতভূমিতে। বিভেদ উড়িয়ে বাংলা থেকে ফের সম্প্রীতির নিশান উড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলা চিরকাল দেশকে পথ দেখিয়েছে, এবারও মুখ্যমন্ত্রী সেই পরম্পরা বজায় রেখেছেন।’’ মন্দির উদ্বোধনে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট অতিথিদের এই চা-চক্রে বাংলা-মুম্বইয়ের শিল্পীরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন কবি-সাহিত্যিক, বণিকসভা ও ময়দানের ক্রীড়াকর্তারাও। মঙ্গলবার মহাযজ্ঞের শেষ পর্বে পুর্ণাহুতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ক’দিন ধরে হয়েছে সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় রীতি মেনে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান। সেখানে যেমন পুরীর দৈতাপতি ছিলেন, তেমনই ইসকনের পূজারি-কর্তারা বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পুরোধার্য। সমস্তটাই তদারকি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিনই তিনি দিঘায় উপস্থিত পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, আনুষ্ঠানিক দ্বারোদঘাটনের পরই সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে মন্দির। পাশাপাশি তিনি স্পষ্ট বলেন, “পর্যটনের দিক থেকে আগামীদিনে দিঘা আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত হবে। এই মন্দির হবে দেশের গর্ব।” মন্দিরের স্থাপত্য বা নির্মাণের আজিক-কৌশল দেখে আপ্লুত মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেই দেন, “এত সুন্দর স্থাপত্য ও কাজ এত সুন্দর-নিখুঁত হয়েছে যে বলার নয়। সব সম্প্রদায়ের মানুষ এসেছেন।” মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেন, “যতটা সম্ভব পেরেছি, করেছি।” বছর সাতেক আগে তিনি এই সমুদ্রসৈকতেই হাঁটতে হাঁটতে ভেবেছিলেন জগন্নাথ মন্দির স্থাপনের ভাবনা। তাঁর মনে হয়েছিল, পুরীর মতো অনবদ্য সৈকত-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি সবটাই দিঘায় রয়েছে। অক্ষয়তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে সেই স্বপ্নই পূরণ হল। মন্দির উদ্বোধনের সাক্ষী থাকতে রাজ্যের বহু পুণ্যার্থী হাজির সৈকত শহরে।