ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের আগে ঘুরে দাঁড়াতে ব্রিগেডে সমাবেশ করল সিপিএম। আর প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে করা সেই সমাবেশ থেকেই তৃণমূলকে উৎখাত করার ডাক দিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। একইসঙ্গে নানা ইস্যুকে হাতয়ার করে নিশানা করলেন কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলকেও। শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, বস্তি এই চার গণসংগঠনের ডাকে রবিবার ব্রিগেড সমাবেশের আয়োজন করে সিপিএম। সেখানেই তৃণমূল ও বিজেপিকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন মহম্মদ সেলিম। তাঁর আগে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাংলার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায় ব্রিগেডে ঝড় তোলেন ক্ষেতমজুর সংগঠনের নেত্রী বন্যা টুডু। তৃনমূলকে উৎখাতের ডাক দিয়ে তিনি বলেন, ওঁরা বলছেন, খেলা হবে। খেলা আমরাও করব। ২৬-এ আমরাও দেখিয়ে দেব। আমরা উইকেট ফেলব।’’ আর বন্যা টুডুর বক্তব্যের রেশ ধরেই মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘বন্যা লড়াইয়ের ময়দান থেকে উঠে এসেছেন। আমাদের দলের নেতানেত্রীরা টালিগঞ্জ থেকে বা বলিউড থেকে উঠে আসেন না। তাঁরা এসেছেন শ্রমিক, কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করতে। বন্যা টুডু জানিয়েছেন, উইকেট ফেলে দেব। তার জন্য ফুটবলের ভাষাতে আমি বলছি আপনাদের সকলকে একটু নেমে খেলতে হবে’
বন্যা বলেন, ‘‘ক্ষেতমজুর, খেটে খাওয়া মানুষদের লড়াই। শহরের মানুষ আমাদের কথা জানে না। আমরা শেষ দেখে ছাড়ব। লড়াইয়ের পথ থেকে সরব না। আমাদের সরকার ১০০ দিনের কাজ চালু করার কথা বলেছিল। সবাই বলে, ব্রিগেডে এত লোক, কিন্তু ভোটবাক্স খালি। মানুষের রুটিরুজি আর ভোটবাক্স আলাদা। ১০০ দিনের কাজ আমরা ২০০ দিন করতে চাই। টাকা দাও না হলে কাজ দাও। আপনাদের জন্যই লড়াই করছি। আমরা পিছিয়ে যাইনি। তাই মা-বোনেরা ব্রিগেডে এসেছে। আমাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এত চুরি করেছে এত চুরি করেছে, দিদি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। চপ বিক্রি করতে বলছেন। আগামী দিনে আমাদের অনেক কাজ। ব্রিগেড থেকে চলে গেলে হবে না। লক্ষ্মীদের সম্মান থাকে না, তাদের আর ভান্ডার কী? মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, টাকা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে’। ব্রিগেডের সমাবেশ থেকে সেলিম বলেন, ‘‘যাঁরা দূরবীন দিয়ে লাল ঝান্ডা দেখতে পাচ্ছিল না, তাদের বুকে কাঁপন ধরাবে এই ব্রিগেড। কাজের জায়গা ছোট হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্র, রাজ্যে কোথাও নিয়োগ হচ্ছে না। যেখানে নিয়োগ হচ্ছে, সেখানে দুর্নীতির পাহাড়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ২৬ হাজার মানুষের চাকরি গিয়েছে। আমাদের দাবি, সাম্প্রদায়িক হিংসা যে ছড়াবে, পুলিশকে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। না হলে আমরা রাজ্যের সব থানায় এফআইআর করব। লাল ঝান্ডা কোনও কাপড়ের টুকরো না। চিটফান্ডের টাকা দিয়ে তা কেনা হয়নি। এত রোদে কী ভাবে লাখ লাখ মানুষ বসবেন, অনেকে চিন্তা করছিলেন। কিন্তু আমাদের প্রতি প্রকৃতিও সহায়। তপ্ত রোদ ওঠেনি। আমি মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জে গিয়েছিলাম, সুতিতে গিয়েছিলাম। কোথাও পুলিশের গুলিতে কোথাও হামলাকারীদের আক্রমণে মানুষ মারা গিয়েছেন। আমি সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে তাঁদের কাছে গিয়েছিলাম। হিংসা দেখলে ডান্ডাগুলোকে মোটা করতে হবে। দেশ বাঁচাতে হলে আবার লাল ঝান্ডাকে মজবুত করতে হবে।’’ ব্রিগেড মঞ্চ থেকে মুর্শিদাবাদ প্রসঙ্গ তুলে সেলিম বলেন, ‘‘দুর্নীতিবাজদের চোদ্দ তলা থেকে মাটিতে টেনে নামানোর শপথ নিতে হবে আমাদের। গরিব মানুষের লড়াই স্যুট-বুট পরে লাট-বেলাট লড়তে পারবে না। গরিবকেই লড়তে হবে। বাঁচতে গেলে হিন্দু মুসলিম একসঙ্গে লড়তে হবে। লড়াইকে আমরা ভয় পাই না। কিন্তু সেই লড়াই মন্দির, মসজিদকে ঘিরে নয়। ধর্মের নামে বেসাতি যারা করে, বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমরা মুর্শিদাবাদকে বাংলাদেশের মতো সংখ্যালঘু নিধনের জায়গা হতে দিতে পারি না। লড়ে যাওয়ার শপথ নিতে হবে তাই। আমাদের লড়াই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজ, মা-বোনের ইজ্জত রক্ষার জন্য, সম্প্রীতির জন্য লড়াই। তৃণমূল-বিজেপির হাতে বাংলার সর্বনাশ হতে দেব না। সব ধর্মের অধিকার রক্ষা করে সরকার চালাতে হবে। এখন তো সরকারই বলছে মন্দির-মসজিদ চালাবে। ট্রেনটা ভাল করে চালাক আগে। কেন্দ্র ট্রেন বেচে দিচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার ট্রাম বেঁচে দিচ্ছেন। আসলে তৃণমূল বিজেপির স্ক্রিপ্ট এক। তা লেখা হয়েছে নাগপুরে। লিখে দিয়েছেন মোহন ভাগবত।’’ সেলিম আরও বলেন, ‘‘ওয়াকফের সংশোধন নিয়ে বিরুদ্ধে গোটা দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে, শুধু বিজেপি আর তৃণমূলের পাঁচ-ছ’জন সাংসদ ছাড়া। কোথাও তো অশান্তি হচ্ছে না। এখানে হল কেন? মুর্শিদাবাদে যাঁরা খুন হলেন, তাঁদের সমস্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা চাই বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক। কারা ষড়যন্ত্র করল, নেপথ্যে কারা ছিল, সব বেরিয়ে আসবে। বহিরাগতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। তারা ভিতরে ঢুকলেন কী ভাবে? আমি বলব, হিন্দু আর মুসলমান লড়াই কোরো না। লড়তে হয় বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়ো। ২৬-এর লড়াইয়ের শুরু এখান থেকেই হোক। গ্রামে গ্রামে এই লড়াই ছড়িয়ে দিতে হবে।’’ মহম্মদ সেলিম ও বন্যা টুডু ছাড়াও বক্তব্য রাখেন কৃষকসভার অমল হালদার, খেতমজুর সংগঠনের নিরাপদ সর্দার, বস্তি উন্নয়ন সমিতির সুখরঞ্জন দে, সিটুর অনাদি সাহু। ব্রিগেড সমাবেশ থেকেই কার্যত ছাব্বিশের প্রস্তুতি শুরু করে দিল সিপিএম।