ছোটদের মধ্যে একটু ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ দেখলেই আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি! সেই ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ যে আসলে অটিস্টিক শিশু–কিশোরদের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক, তা বেশিরভাগ মানুষই জানেন না বা বুঝতে পারেন না।
রাস্তাঘাটে, বিনোদন পার্কে অথবা কোনও শপিং মলে অটিস্টিক শিশুদের করুণার নজরেও দেখা হয়। কোথাও কোথাও কেউ না জেনেই ‘পাগল’ শব্দটি জুড়ে দেয়। কেউ একবারও ভাবে না যে, ওই শিশুর বাবা, মায়ের মন কতটা ভারাক্রান্ত হতে পারে এই শব্দ আঘাতে।
জানা জরুরি, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারস (এএসডি) কোনও নির্দিষ্ট রোগ নয়, স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটু অসুবিধা। সেই অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে অক্সিজেনের মতো কাজ করে সামার ক্যাম্প বা গ্রীষ্মকালীন শিবির। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামার ক্যাম্পগুলি অটিস্টিক শিশুদের জন্য অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। ওদের সামাজিকভাবে মেলামেশার দক্ষতা বাড়াতে, স্বাধীনভাবে কাজ করতে, ব্যক্তিগত মনোযোগ বাড়াতে, ভাগ করে কাজ করা শিখতে, সংবেদনশীল কাজ করতে এবং সর্বোপরি বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। শিবিরগুলিতে শিশুদের চাহিদা অনুসারে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়, যাতে ওরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ পায়। কলকাতায় বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য তৈরি বিভিন্ন সেন্টার সামার ক্যাম্পের আয়োজন করে থাকে। লেকটাউনের এক ইনস্টিটিউট এরকমই এক সপ্তাহ ব্যাপী অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে সামার ক্যাম্পের আয়োজন করে। ১৫ জন শিশু তাতে অংশ নেয়। সাতদিন ধরে বিভিন্নরকম কর্মসূচি ছিল। নাচ, যোগা, ফুচকা পার্টি, গল্প বলা, নাটক, কাগজ কেটে ছবি এঁকে প্রাণীদের মুখোশ তৈরি করা, বিনোদন পার্কে ঘোরা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া–দাওয়া, সিনেমা দেখা, কী ছিল না সেখানে! নিজেদের ইনস্টিটিউট ছাড়াও অন্য স্পেশ্যাল স্কুল থেকেও শিশুরা অংশ নেয় এই ক্যাম্পে। সঙ্গে ছিলেন অভিভাবক, প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা সুমিত্রা পাল বক্সি, দিপ্তি কর থেকে শুরু অন্যান্য শিক্ষক ও স্পেশ্যাল এডুকেটর।
১০ বছর ধরে স্পেশ্যাল এডুকেটরের অভিজ্ঞ শিক্ষক বুদ্ধদেব চক্রবর্তী বলেন, ‘এই সামার ক্যাম্পের লক্ষ্য ছিল ছুটির সময়ে যাতে শিশুরা কিছু না কিছু কাজের মধ্যে দিয়ে কাটাতে পারে। যা তাদের সামাজিক বিকাশে উন্নয়ন ঘটাবে। ছোট ছোট ক্যাম্পে সকল পড়ুয়াদের একত্রিত করে বিভিন্ন কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে পারলে ওরাও এই সামাজিক বিকাশের বাধা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আমাদের কর্মসূচিগুলি দেখে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষও সচেতন হতে পারলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল।’
অন্যান্য স্পেশ্যাল এডুকেটরের বক্তব্য, রোজকার জীবনে, সমাজে মেলামেশার দক্ষতা বাড়াতে, সমবয়সীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে, খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করতে সাহায্য করে এই ধরণের ক্যাম্প। দৈনন্দিন রুটিনের বাইরে নতুন পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করানো হয়। সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস বাড়াতেও সাহায্য করে।
দমদম থেকে শিল্পী বর্মন তাঁর ৭ বছরের মেয়ে স্নেহানিকে নিয়ে এসেছিলেন এই ক্যাম্পে। মেয়ের যখন আড়াই বছর বয়স তখন ধরা পড়ে অটিজম। প্রথমে জানার পর একটু ভেঙে পড়লেও হাল ছাড়েননি শিল্পী। লড়াইটা শুরু করে দেন। শিল্পী বলেন, ‘ধৈর্য্য ধরতে হবে। কথা বলায় একটু সমস্যা ছিল। বিভিন্ন রকম থেরাপির মাধ্যমে আগের তুলনায় মেয়ের কথা বলায় এখন অনেক উন্নতি ঘটেছে। পরিবারের পাশে থাকা খুব প্রয়োজন, যা আমি পেয়েছি।’
বাগুইহাটি জ্যাংড়ার বাসিন্দা সোনি গুপ্তার একমাত্র ছেলে হিমাংশু। বয়স ৯ বছর। ক্যাম্পে কিছুক্ষণ কাটিয়ে সেই সোনি বলেন, ‘এই ক্যাম্পে এসে ছেলের খুব ভাল লেগেছে। তিন বছর ধরে এই সেণ্টারে আমি যাতায়াত করছি। ছেলের এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। সাড়ে তিন বছর বয়সে লক্ষ্য করি, সকলের সঙ্গে ওর মিশতে অসুবিধা হচ্ছে। তখনও জানতাম না অটিজম কী? পরে জানতে পেরে পরিবারের সবরকম সাপোর্ট নিয়ে এগিয়ে চলেছি।’
বাকি অভিভাবকেরাও এগিয়ে চলেছেন। যাঁদের ঘরে, পরিবারে অটিস্টিক শিশু–কিশোর নেই, তঁারাও যাতে এই ব্যাপারটা সংবেদনশীলতার সঙ্গে বুঝতে পারেন, সেই আশা করেন ক্যাম্পে আসা বাবা–মায়েরা।